ভাঙন আতংকে ভুলে গেছে ওরা ঈদের আনন্দ

মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক:

রাত পোহালেই মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। আতংক, অভাব ও চরম হতাশায় নির্ঘুম সময় কাটে যমুনাপাড়ের দুই শতাধিক পরিবারের। ঈদ উপলক্ষে নেই বাড়তি আয়োজন, নেই মনে আনন্দ। এমনই কঠিন পরিস্থিতিতে মানিকগঞ্জের নদী পাড়ের বাসিন্দাদের। ভাঙনের তাড়া কেড়ে নিয়েছে তাদের চোখের ঘুম। ঈদ তাদের জন্য আনন্দের নয়; কেবলই বিবর্ণ বেদনার। লালপুর গ্রামের ভাঙনের অপেক্ষায় প্রতিক্ষারত তমিজ শেখ জানালেন, “ঈদের একটা দিন; পুলাপানের গতরে নতুন জামা দিতে পারলাম না। দিমু কেমনে, দু’বেলা খাওনই জুটে না। ভাঙন আমাগো চোখের ঘুম কাইরা নিছে।”

01অসময়ে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে যমুনায়। পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে ভাঙনের তীব্রতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। গত দুই সপ্তাহে ভাঙনে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা। ৮টি গ্রামের প্রায় অর্ধশত পরিবার গৃহহীন ও ১০০ একর ফসলি জমি যমুনার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনকবলিত ইউনিয়নগুলো হলোÑ চরকাটারী, বাঁচামারা ও বাঘুটিয়া ইউনিয়ন। সহায় সম্বল হারিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন ওই সব এলাকার মানুষেরা। ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে চরকাটারী ইউনিয়নের লালপুর, চরকাটারী, কাঁঠালতুলি, চরকাটারী ম-লপাড়া, বোর্ড ঘর বাজার, চরকাটারী বাজার এলাকায়। যমুনা পাড়ে হুমকির মুখে পড়েছে ওই সব এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদরাসা, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, ইউনিয়ন পরিষদ, ভূমি অফিসসহ শত শত বাড়িঘর ও ফসলি জমি।

নদীভাঙনে ইতোমধ্যে ঐতিহ্যবাহী চরকাটারী সবুজ সেনা উচ্চবিদ্যালয়, চরকাটারী বাজার, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভূমি মসজিদ, মাদরাসা ও অর্ধশত বাড়িঘর আবাদি জমি ভাঙনের শিকার হয়েছে। বৃহস্পতিবার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে যমুনা নদীর ভাঙনের শিকার ওই এলাকার খেটে খাওয়া মানুষ ঘরবাড়ি-জিনিসপত্র অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। কেউ কেউ নিজের ভিটেমাটি হারিয়ে অন্যের জমির ওপর আশ্রয় নিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কমপক্ষে ৫০ টি পরিবার গৃহহীন ও ১০০ একর ফসলি জমি যমুনার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

02প্রতিদিনই একের পর এক নতুন পরিবার গৃহহীন ও ফসলি জমি নদীতে হারিয়ে যাচ্ছে। অসময়ের ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পরছে তারা। ভাঙনের শিকার এসব এলাকার বাধেঁর পাদদেশে ও খোলা আকাশের নীচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। কেউ কেউ আবার আশ্রয় নিয়েছে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি কিংবা স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। দৌলতপুর উপজেলার চরবারাঙ্গা গ্রামের প্রবীণ সমেজ প্রামাণিক। গত ২ যুগে ৮ দফা ভাঙনের শিকার হয়েছেন। তার ৪০ বিঘা জমি ও ঘরবাড়ী ছিল। এখন কিছুই নেই, সবই যমুনা নদীতে বিলীন হয়েছে। ইপিজেড এলাকায় কুলির কাজ করে চলে তার সংসার। তিনি জানান, “নতুন জামা কাপড় তো দূরে থাক, ঈদে মুখে একটু ভালো খাবার দিতে পারা নিয়ে সংশয় তার। কথাগুলো বলার সময় ছলছল নয়নজুড়ে তরতর করে বেরিয়ে এলো তার ভেতরের চাপা কান্না।”

চরকাটারী মন্ডল পাড়ার আবদুল খালেক মন্ডল এ প্রতিবেদককে জানান, নদীতে হঠাৎ পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ভাঙন শুরু হয়। এবার নিজের বাড়িতে থাকতে পারবেন কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি। চরকাটারী বোর্ড ঘর বাজার এলাকার আলমগীর হোসেন জানান, যমুুনা নদীর ভাঙনে বাড়িঘর, জায়গা-জমি নদীতে বিলীন হওয়ায় গরু-ছাগল নিয়ে এখন অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে কোনো মতে থাকছেন।

দৌলতপুর উপজেললায় যমুনার তীরবর্তী বাচামারা ইউনিয়নের ৪৪ নং বাচামারা উত্তরখন্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শত শত শিক্ষার্থীর কোলাহলে মুখরিত ছিল সেই স্কুলটি যে কোনও মূহুর্তে যমুনা নদীর গর্ভে বিলীনের পথে। ৪৪ নং বাচামারা উত্তরখ- সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রিক্তা আক্তার জানায়, “এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শত ভাগ পাশ করে।” ৩ বছর ধরে বিদ্যালয়টি ভাঙনের আশঙ্কার কথা জানিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে কয়েকবার চিঠি লেখা হলেও তারা ভাঙন রোধ কিংবা ভবন স্থানান্তরের কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ১৯৬৯ সালে স্থাপিত এ বিদ্যালয়ে বিগত অর্থ বছরে ৩৯ লাখ ৫৪ হাজার টাকা ব্যয় করে দ্বিতল ভবনটি করা হয়েছিল।

বাচামরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ জানান, “জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেললে স্কুলের ভবনটি রক্ষা সম্ভব। এই এলাকাটির ভাঙন ঠেকাতে সাড়ে ৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এরইমধ্যে তার ইউনিয়নের ৩০/৪০ একর জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।”
সর্বনাশা যমুনা নদীর করাল গ্রাসে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চল চরকাটারী সবুজ সেনা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবন নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বিদ্যালয়টির ১৫’শ ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা জীবন অনিশ্চিয়তার মধ্যে পরে গেছে। কাঁঠালতুলী গ্রামের স্কুল শিক্ষার্থী আয়েশা আক্তার, মাদ্রাসা ছাত্র মো. আমিনের মতো অসেক শিশুর ভাগ্যে জোটেনি এবার ঈদের নতুন পোশাক। তারাও তাদের পরিবারের অন্য সদস্যের সাথে ঘরবাড়ি সড়াতে ব্যস্ত, ঈদ আনন্দের ছোঁয়া লাগেনি তাদের মনে।

চরকাটারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল বারেক ম-ল জানান, “যমুনা নদীর ভাঙনে চরকাটারী স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কল্যাণ কেন্দ্র, দু’টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শত শত বাড়িঘর, আবাদি জমি নদীতে চলে গেছে। তিনি ভাঙন প্রতিরোধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।

দৌলতপুর উপজেলা চেয়ারম্যান তোজাম্মেল হক তোজা বলেন, “এই এলাকার মানুষের মনে নদী ভাঙন আতংক বিরাজ করে। নদী ভাঙনে সর্বশান্ত হয়ে কিংবা ভাঙনের হুমকীর মুখে থাকা বাড়ির মানুষজন মাথা গোজার ঠাঁইটুকুকে রক্ষা করতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ঈদের আগেই ভাঙ্গন কবলিত মানুষের জন্য নগদ অর্থ ও খাদ্যের ব্যাবস্থা করা হয়েছে এবং সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান -ব্যক্তি পর্যায়ে নতুন পোশাক বিতরণ করা হয়েছে।”

happy wheels 2

Comments