কৃষক গবেষক দল গঠন: উপকূলীয় প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর জনগোষ্ঠীর সমন্বিত উদ্যোগ

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে পার্থ সারথী পাল এবং বিশ্বজিৎ মন্ডল

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতিবৃষ্টি, জলোচ্ছাস ও লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় কৃষি বিপদাপন্ন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতিবছর মৌসুমী ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কখনো ধান গাছ মারা যাচ্ছে, ফলন কম হচ্ছে, ফসলের পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশি হচ্ছে, গাছ পরিপক্ব হচ্ছে না, গাছ সতেজ দেখতে ভালো কিন্তু কোন ফলন নেই, গাছের পাতা কুচকে যাচ্ছে, গাছ লাল হয়ে মারা যাচ্ছে, বীজতলায় বীজ বারবার ফেলতে হচ্ছে। এমন অনেক ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। আর এ সমস্যা থেকে উত্তোরণের জন্য উপকূলীয় কৃষক-কৃষাণীরা অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কখনো লবণ পানির চিংড়ি ঘেরের পাশে ধান লাগিয়ে, কখনো জলাবদ্ধতা জায়গায় ধান লাগিয়ে, ব্যক্তি পর্যায়, সমন্বিত ভাবে বা সংগঠিত হয়ে আমন ও আউশ মৌসুমের ফসল লাগানোর চেষ্টা করছে। ধানের পাশাপশি শিম, মসলা, স্থানীয় প্রানী সম্পদ (মুরগি) নিয়ে পরীক্ষামুলক গবেষণা চেষ্টা করে যাচ্ছে।

pic-1
তাদের এ কাজকে উৎসাহিত করে বারসিক ২০০১ সাল থেকেই তাদের পাশে থেকেছে, তাদের কর্মউদ্যোগ ও প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করার পাশাপশি ঐক্য ও সমন্বয়ে সংগঠন গড়ে তুলতে সহযোগিতা করেছে। এ ধারাবাহিক কর্মপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ২১টি জনসংগঠন, একটি উপজেলা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটি গড়ে উঠেছে। স্থানীয়রা বিগত কয়েকমাস যাবত উপজেলা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটির সভা, এবং জনসংগঠনের কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন বিষয়ক সমন্বয় সভায় শ্যামনগর এলাকার জন্য একটি কৃষক গবেষক দল গঠনের প্রস্তাব, সুপারিশ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যেখানে কৃষক নিজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন তার জমির জন্য কোন জাত উপযুক্ত, কোন সময়ে তা লাগানো হবে, সে জাতের কি গুণাবলী সে নিজে জানবেন এবং অন্যদেরকে জানাবেন, সহায়তা ও পরামর্শ প্রদান করবেন।

বিগত সময়ে বিভিন্নভাবে কর্মএলাকার জনসংগঠন ও জনগোষ্ঠী ধারবাহিকভাবে এ কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁরা এ গবেষণার ফলাফল কৃষক থেকে কৃষক, এক জনগোষ্ঠী থেকে অন্য জনগোষ্ঠী, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক ইউনিয়ন থেকে অন্য ইউনিয়নে এবং উপজেলায় সম্প্রসারণ করছেন। মূলত এলাকার জন্য উপযুক্ত জাত নির্বাচন (ধান, সবজি, মসলা ও প্রানী সম্পদের) করা, বিভিন্ন জায়গায় তা লাগিয়ে দেখা, মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন ফসল লাগানো, দেশীয় প্রাণী সম্পদ পালন ও ব্যবহার বৃদ্ধির চেষ্টা করে যাচ্ছেন এই কৃষকেরা। পাশাপাশি তাঁরা এলাকা ঘুরে দেখেন কি কি জাত চাষ হচ্ছে, কারো কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা, সমস্যা হলে তা কিভাবে সমাধান করা যাবে!

এরই ধারাবাহিকতায় বিগত ৩০ মে বারসিক শ্যামনগর রিসোর্স সেন্টার কার্যালয়ে কর্মএলাকার আগ্রহী ও অভিজ্ঞ কৃষক-কৃষাণীদের অংশগ্রহণ ও আলোচনার মাধ্যমে ১৫ সদস্যের একটি কৃষক গবেষক দল গঠন করা হয়। কৃষক গবেষক দলে প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে কৃষক শেখ সিরাজুল ইসলাম ও বারসিকের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী পার্থ সারথী পাল, সভাপতি-শ্রী দেবীরঞ্জন মন্ডল, সহসভাপতি রাবেয়া সুলতানা, কৃষক নজরুল ইসলাম, অল্পনা রানী মিস্ত্রি, সাধারণ সম্পাদক, কৃষক দিলিপ তরফদার, যুগ্ম সম্পাদক বনজীবী নারী শেফালী বিবি, বিভাস চন্দ্র মন্ডল, এবং যথাক্রমে অর্চনা রানী মন্ডল, কাঞ্চন বৈদ্য, ছাত্র সৌমিত্র মন্ডল, কৃষক আব্দুল হামিদ, নিরঞ্জন জোয়ারদার ও কুমুদরঞ্জন গায়েনকে সম্মানিত সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে।

pic-2
কমিটি গঠনের সাথে সাথেই সামনে মৌসুমে কি কি কাজ করা হবে তা পরিকল্পনায় যুক্ত করা হয়। নতুন এই গবেষক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ প্রসঙ্গে নব্য সভাপতি কৃষক দেবীরঞ্জন বলেন, “আমরা যদি এ কমিটিকে পূর্নাঙ্গ রূপে গঠন করতে পারি তাহলে উপকূলীয় এলাকার কৃষি সমস্যা সমাধানে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমরা আমাদের এলাকার সমস্যা সমাধানে একত্রিত হয়ে কাজ করবো। কৃষি যে কোন সমস্যা সকলের পরামর্শ সহায়তা করার চেষ্টা করবো। সমন্বিতভাবে আমরা উপকূলীয় প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য এ দল গঠন করা জরুরি।” কৃষক দিলিপ তরফদার বলেন, “গবেষক দল তৈরি মানে নতুন কিছু না আমরা যে কাজটা করি সেটাকে আরো ভালোভাবে করা। আমি চারুলতা ধান সংকরায়নের মাধ্যমে পেয়েছি যে ধান ফলন বিআর-২২ ধানের মতো এবং জলাদ্ধতা এবং কিছুটা লবণ সহনশীল। কারো যদি এ জাত লেগে থাকে তাহলে আমি বীজ দিতে পারবো। আগামীতে আমরা উপকূলীয় এলাকার জন্য আরো নতুন জাত উদ্ভাবন করতে পারবো এবং এলাকা ভেদে জাত বাছাইকরণ করবো।” কৃষানী অর্চনা রানী মন্ডল বলেন, “আমরা বাড়িতে শুধু মাত্র ঝাল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ লাগাতাম। গত বছর আমি এর সাথে জিরা, কালোজিরা, ধনিয়া লাগিয়ে ছিলাম সেগগুলো মোটামুটি ভালো ছিল। এ বছর আমি যদি সকলের পরামর্শ পাই তাহলে আরো ভালোভাবে করতে পারবো এবং এলাকার অন্য মানুষেরা আগ্রহী হবে বলে আমারা বিশ্বাস।”

এই কৃষক গবেষক দল উপকূলীয় জনপদের বিভিন্ন পেশার জনগোষ্ঠী এবং তাদের নিজেদের উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম হবে এবং উপকূলীয় প্রাণবৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদনির্ভর জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রাকে গতিশীলতা আনয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

happy wheels 2

Comments