হাজার বছরের ঐতিহ্য ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল শিল্প

আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ থেকে ॥

অভিজ্ঞ শিল্পীর গভীর মনোযোগ, বয়সী হাতে নিখুঁতভাবে তৈরি হচ্ছে ভাস্কর্য। মোমের তৈরি এই মডেলের ওপর প্রথমে মাটির প্রলেপ দেয়, যখন শক্ত আকার ধারণ করে তখন দেওয়া হয় মোমের প্রলেপ। এরপর মোম গলে ভেতরটা ফাঁপা হয় আর সেখানে গলিত কাঁসা ঢেলে দেয়া হয়। আবারও চলে ঠুকঠাক হাতের ছোঁয়ার নিপুণ কারুকাজ। এরপর ঠাণ্ডা হলে পলিশ করা হয় ‘এন্টিক লুক’ আনার জন্য। এভাবেই তৈরি হয়ে গেলো কাঁসা-পিতলের “রাধা-কৃষ্ণ” ভাস্কর্য। যার চাহিদা ও সুনাম দেশ ছাপিয়ে বিশ্বব্যাপী। ধামরাইয়ে কাঁসা-পিতল শিল্পের এই যাত্রা শুরু হয় পাল বংশের আমলে। হাজার বছরের বেশি সময়ের ইতিহাসের সাক্ষী ধামরাইয়ের ঐতিহ্যবাহী এই কাঁসা-পিতল শিল্প। বর্তমানে বিশ্ববাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও সঠিক প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বাজার পাচ্ছে না এই শিল্প। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে হারিয়ে যেতে বসা এই শিল্প রক্ষায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণের দাবি সংশ্লিষ্টদের।

সরেজমিনে দেখা যায়, ধামরাই রথখোলা বাজারে কাঁসা-পিতল পণ্য বিক্রির দোকানগুলো রয়েছে সেখানেও অপেক্ষা, হিন্দু বিয়ের উপলক্ষ কিংবা সৌখিন ক্রেতার। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এক দশক আগেও শতাধিক শিল্প-কারখানা ছিল ধামরাইতে। কিন্তু এখন হাতেগোনা দু-তিনটি টিকে আছে। বাকিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো টিকে আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো সুকান্ত বণিকের কারখানাটি। পাঁচ পুরুষের বনেদি ব্যবসার হাল ধরে রেখেছেন সুকান্ত বণিক। পড়ে আছেন মৃতপ্রায় ব্রাশ মেটাল শিল্প বা কাঁসা-পিতলের শিল্প নিয়ে। ধামরাইয়ের বিখ্যাত রথটি পার হলেই হাতের ডানেই দেখা যায় রাশেদা মোশাররফের পিতলের বড় শো-রুম। দোকানের ভেতরে ঢুকেই চোখে পড়ে সারি সারি পিতল দিয়ে বানানো নানা ধরনের ভাস্কর্য। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীর নানা ধরনের চরিত্র এখানে এসে বাস্তব রূপ পেয়েছে। বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি, রাধা-কৃষ্ণ, অবতার, নটরাজ, উমা মহেশ্বর, কালিয়া কৃষ্ণ, স্বর্পছায়ায় বিষ্ণু, তারা, ত্রিনাথ, শিব, পার্বতী- এসব নানা বিগ্রহের বিশাল সম্ভার রয়েছে এখানে। সঙ্গে আছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্যাদি। একটু এগোলেই ডানের গলিতে তার বাসা। বাঁয়ে সুকান্ত বণিকের বিশাল পুরনো ভবন। ভবনটির মোট ২৭টি রুমের সাতটি নিয়ে গড়ে তুলেছেন তার এই শো-রুম। দোকানের ভেতরে দেখা যায়, সারি সারি কাঁসা-পিতল দিয়ে বানানো নানা ধরনের ভাস্কর্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। আর আছে সুকান্তের নিজের আইডিয়ায় তৈরি বিশাল দাবার দুটি বোর্ড।

M.gonj 1 (1)

বাংলাদেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে কাঁসা-পিতলের ব্যবহার। একসময় আমাদের দেশে পিতলের জিনিসপত্র ব্যবহারের খুব প্রচলন ছিল। বিশেষ করে রান্নাঘরের তৈজসপত্র ও ব্যবহার্য সামগ্রীর ক্ষেত্রে পিতলের থালা, বাটি, গ্লাস, রান্নার হাঁড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো। সাধারণত জমিদারবাড়ী ও অভিজাত পরিবারগুলোতে বেশি দেখা যেত পিতলের তৈজসপত্র। তামা কাঁসার জিনিসপত্র ব্যবহারকে অভিজাতের প্রতীক হিসাবে দেখা হতো।

ঢাকা জেলার বৃহত্তম উপজেলা ধামরাই এলাকা কাঁসা-পিতলের জন্য বিখ্যাত ছিল। ওই সময় শুধু বাংলাদেশ নয়, দেশের বাইরেও ছিল এর প্রচুর চাহিদা। এছাড়া বিদেশি পর্যটকরা একসময়ে কাঁসা-পিতলের মধ্যে কারুকাজ খচিত বিভিন্ন দেবদেবী ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি জিনিসপত্রগুলো নিয়ে যেত। কিন্তু এই কাঁসা-পিতল শিল্পের ঐতিহ্য আজ নানা সমস্যার কারণে দিনে দিনে হারিয়ে যেতে বসেছে। এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পের সাথে জড়িত শিল্পী ও ব্যবসায়ীরা আজ অভাব অনটনে দিন কাটাচ্ছে। তাদের দেখার ও কেউ নেই। বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে আজ কাঁসা-পিতল শিল্পে জড়িতরা বিভিন্ন পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছে। এই কারুশিল্পী ও ব্যবসায়ীদের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কখনোই কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কেউ।

M.gonj 1 (2)

বাংলাদেশে কিংবা অবিভক্ত বাংলায় কাঁসা-পিতলের প্রচলন কখন, কিভাবে শুরু হয়েছিল তা নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, এটি প্রাচীন সভ্যতার আমলে শুরু, যখন ব্রোঞ্জশিল্প ছিল। আবার অনেকেই এই শিল্পকে মহাস্থানগড়কেন্দ্রিক সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে মনে করেন। আনুমানিক ১৫৭৬-১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে মোঘল আমলে উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে কাঁসা-পিতলের ব্যবহার শুরু হয়। তখন এসব ধাতু দিয়ে ঢাল, তলোয়ার, তীর-ধনুক ইত্যাদি যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরি করা হতো। ব্রিটিশ শাসন আমলেও এ শিল্পের প্রসার ঘটে এবং বাংলার ঘরে ঘরে এর ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সে সময় ঢাকার ধামরাই, শিমুলিয়া ছাড়াও টাঙ্গাইলের কাগমারী, জামালপুরের ইসলামপুর, বগুড়ার শিববাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে কারখানা গড়ে উঠতে শুরু করে।

কালের বিবর্তনে পিতলসামগ্রীর ব্যবহারের মাত্রা দিন দিন কমে গেলেও সৌখিন মানুষের কাছে এর চাহিদা রয়ে গেছে বৈকি! অন্দরসজ্জার উপকরণ হিসেবেও ইদানীং ঘরে শোভা পাচ্ছে পিতলের সামগ্রী। এসবের মধ্যে রয়েছে নানা রকম শো-পিস, ওয়াল ম্যাট, ফুলের টব, বিভিন্ন ধরনের গ্লাস, থালা, বাটি, কাজলদানি, চামচ, হুক্কা, কলস, পূজার ঘন্টা, গামলা, চামচ, বালতি, ডেগ, কড়াই প্রদীপ, বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, সঙ্গীত সাধনার যন্ত্র, খেলনা, আয়নার ফ্রেম ইত্যাদি তৈরি করতেন। তখনকার দিনে এসব জিনিসের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও।

পিতলসামগ্রী শিল্পের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যক্তিগত উদ্যোগে অভিবাসী বাংলাদেশিরাও তামা-কাঁসায় গড়া শিল্প পণ্য বিদেশে নিতে সাহস দেখান না, পাছে আবার পুরাকীর্তি পাচারের অভিযোগে আটক হন। আবার প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র পেতে কখনো কখনো সময় লাগে এক থেকে দেড় বছর। ফলে বিদেশের বাজারে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এ পথে পা মাড়ান না অনেক আগ্রহী উদ্যোক্তা। এ ছাড়া চাহিদামতো কাঁচামাল না পাওয়ার পাশাপাশি নেই সরকারের কোনো সহযোগিতাও। সরকার সহযোগিতা করলে এ শিল্পপণ্য রপ্তানি করে দেশে প্রচুর বিদেশি মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

এ ব্যাপারে সরেজমিনে কথা হয় ধামরাই মেটাল ক্রাপ্টস এর স্বত্বাধিকারী সুকান্ত বণিকের সঙ্গে। প্রায় দুইশ বছর ধরে তার পূর্বপুরুষরা এ পেশার সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, ‘ধামরাই উপজেলা সদরেই নোটা, ঘটি, হাড়ি-পাতিল, থালা, গ্লাস, বদনি ও বিভিন্ন শো-পিচ, দেবদেবী ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি জিনিসপত্র তৈরির জন্য স্বাধীনতার পূর্বেও প্রায় ৩০/৪০টি কারখানা ছিল। বর্তমানে এ কারখানা সংখ্যা ৪/৫টি মতো। সময়ের সাথে পাপ্লা দিয়ে প্লাাস্টিক, লোহা ও স্টিলের তৈরি এসব জিনিসপত্র তৈরি হওয়ায় কাঁসা-পিতল কেনায় বেশ ভাটা পড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কাঁসা-পিতলের তৈরি জিনিসপত্র একবার কিনলে তা ২০/৩০ বছরের বেশি সময় ব্যবহার করা যায়। শুধু তাই নয়, যে দামে কেনা হতো ব্যবহারের পর তার চেয়েও বেশি দামে বিক্রি করা যেত।’ এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘আগে এসব জিনিসপত্র রপ্তানির ক্ষেত্রে তেমন একটা বেগ পেতে হতো না। বর্তমানে রপ্তানি করতে গেলে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।’

ধামরাই মেটাল ক্রাপ্টসে কর্মরত নিমাই পাল (৪৫) নামের এক শ্রমিক। তিনি বলেন, ‘আগে বাপ-দাদার সাথে প্রতিমা তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিলাম। বর্তমানে কাঁসা-পিতলের তৈরির সঙ্গে আমি এখানে ২৩ বছর ধরে কর্মরত আছি।’ তিনি প্রতিমা ও বিভিন্ন দেবদেবীর এবং জীবজন্তুর প্রতিকৃতির কর্মকার। এখানে তিনি প্রতিদিন গড়ে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা উপার্জন করতে পারেন। কথা হয় ৫৫ বছর বয়সী কাঁসা পিতলের ব্যবসায়ী আনিসুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, তার বাপ-দাদার পেশা ধরেই ৩০ বছর যাবৎ ধামরাই বাজারে ব্যবসা করে আসছেন। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পরেও এ ব্যবসা ছিল বেশ জমজমাট। এ বাজারেই ছিল অনেক ব্যবসায়ী। বর্তমানে আছে হাতেগোনা কয়েকজন।’ এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘বর্তমানে শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়ের বিয়েতে উপহার হিসেবে কাঁসা-পিতলের তৈরি কিছু জিনিসপত্র কেনা হয়। তাছাড়া সচরাচর কেউ এসব কিনে না। তাই ব্যবসায় পড়েছে ভাটা।’ শিল্পকর্ম ব্যবসায়ী অরুণ বণিক বলেন, ‘আমরা কাঁসা-পিতলের থালার মধ্যে নকশা করে বিক্রি করলে ২৫০০/২০০০ টাকা দাম পাওয়া যায়। এতে লাভ থাকে মোটে ২০০/৩০০ টাকা।’

এশিয়া মহাদেশের অন্যতম ধামরাইয়ের রথমেলা আর ঐতিহ্যবাহী কাঁসা-পিতল শিল্পের কথা সারা দুনিয়ার মানুষ জানেন। অনেক বিদেশি আসেন এ শিল্প দেখার জন্য। ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতলসামগ্রীর চাহিদা আছে ইতালি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায়। এমনকি অনেক দেশের রাষ্ট্রদূত ধামরাইয়ে এসে কাঁসা-পিতলের সামগ্রী নিয়ে যান। এসবের মধ্যে থাকে বিভিন্ন ধরনের মূর্তি, খাট, জীবজন্তুর ছবিসহ বিভিন্ন জিনিস। এসব তৈরি হয় মোশাররফ হোসেনের কারখানায়। কাঁসা-পিতল শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা ব্যাংকঋণ নিতে সাহস পান না। যদি সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সহযোগিতায় এগিয়ে আসত তাহলে কাঁসা-পিতলসামাগ্রী বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হতো।

M.gonj 1 (3)

ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল কারিগর রাশেদা মোশাররফ বলেন, ‘দেশের ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে বাঁচাতে হলে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে এবং সহজ শর্তে করতে হবে ব্যাংকঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের এসব জিনিস তৈরিতে প্রচুর টাকা প্রয়োজন হয়। আবার দেখা যায়, ব্যবসা কখনো ভালো আবার কখনো খারাপ হয়। অথচ ব্যাংক চড়া সুদে ঋণ দিতে আগ্রহী হয়। আবার ব্যাংক ঋণ নিলে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করতে হয়।’ রাশেদা বলেন, ‘এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার যদি সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করে তাহলে অনেক ভালো হবে।’ তিনি বলেন, ‘গুলশান হামলার ঘটনার পর থেকে বিদেশি ক্রেতা একেবারেই কমে গেছে।’

‘তামা, কাঁসা, পিতল, সোনা চিনলি না রে, চিনলি না। চিনবি সেদিন, চোখে যেদিন তুই কিছুই দেখবি না।’ পথিক নবীর এই গানের মতই আমরা তামা, কাঁসা ও পিতলের শিল্পকে চিনি নাই, মূল্যায়ন করি নাই। যার কারণে এই শিল্পের বর্তমান অবস্থা করুণ। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী তামা কাঁসা শিল্পের সুদিন আনতে সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ও হস্তক্ষেপ কামনা করেন এই ব্যবসায়ের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা। তামা কাঁসা শিল্পে শহজ শর্তে ঋন প্রদান করতে পারলে এবং তাঁদের তৈরি দ্রব্যসামগ্রী বিদেশি রপ্তানি করার ব্যাবস্থা করলে এই শিল্প থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি বহু লোকের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হবে।

happy wheels 2

Comments