সাম্প্রতিক পোস্ট

ইতিহাস ঐতিহ্যের মোহর গ্রাম

রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার

রাজশাহীর তানোর উপজেলার তালন্দ ইউনিয়নের সব থেকে রড় গ্রাম মোহর। ২২টি পাড়ার সমন্বয়ে গঠিত গ্রামটি উপজেলা সদর থেকে ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে। ১২০০টি পরিবারের গ্রামটিতে হিন্দু, মুসলিম, সাঁওতাল, খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের লোকের বসবাস। গ্রামটিতে সারাবছরই প্রচুর পরিমাণে শস্য ফসল উৎপাদন হয়। আর এই গ্রামের উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হচ্ছে পুকুর ও ডোবা। গ্রামে ৫২টি বড় আয়তনের পুকুর আছে। পাশাপাশি আছে ৬৮টি ছোট আকারের ডোবা। প্রতিটি বড় বড় পুকুরগুলোই এক একটি ইতিহাসের নিদর্শন। কথিত আছে, এই ৫২টি পুকুরের মধ্য কোন একটি পুকুরে সাত কলসি সোনার মোহর লুকানো আছে। আর সেই থেকেই গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে মোহর। গ্রামের পুরাতন বড় বড় পুকুরগুলো সবই নাটোরের রানী ভবানীর শাসনামলে খনন করা। কারণ সে সময় এই এলাকায় প্রচন্ড পরিমাণে পানীয় জলের সংকট ছিল। মোহর গ্রামের পুকুরগুলোর রয়েছে আলাদা আলাদা নাম, যেমন-বাঘাপকুর, চাতরা পুকুর, সুড়ি পুকুর, চেতলা পুকুর, ম্যারা পুকুর, ব্যাঙ পুকুর, ঘোড়াডুবি পুকুর। এই গ্রামের পুকুরের সংখ্যা সম্পর্কে মো. ইব্রাহিম হোসেন (৬৯) বলেন, “মোহর গ্রামে আঠারোটি পাড়া, ছয় কুড়ি পুকুর, নয় কুড়ি গাড়া (ছোট-ছোট জলাশয়) এ থেকে আমরা বুঝতে পারি মোহর মোট পাড়া ১৮টি, গ্রামে মোট পুকুর ছিল ১২০টি, ছোট বড় জলাশয় ছিল ১৮০টি। তবে বর্তমানে ছোট-ছোট জলাশয় ও কিছু পুকুর ভরাটের মাধ্যমে নষ্ট হয়ে গেছে। বর্তমানে গ্রামে টিকে আছে ৫২টি পুকুর।’

41961294_355742138300687_79495326343364608_n

ভারতীয় উপমহাদেশে যখন নীল চাষের প্রচলন শুরু হয় ঠিক সে সময়েও বরেন্দ্র অঞ্চলের এ অংশেও নীল চাষের প্রচলন ছিলো। নীল চাষের সুবিধার জন্যই মোহর গ্রামের বাঘাপুকুর পারেও তৈরি করা হয় নীলকুঠি। এ সম্পর্কে গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি মো. সাবেদ আলী (৭২) বলেন, “আমি আমার দাদার কাছে শুনেছি যে, মোহর এলাকায় নীলের চাষ হতো বছরে দুবার। একটি হৈমন্তিক চাষ যা বর্ষার শেষ দিকে এ চাষের বীজ বোনা হতো। দ্বিতীয় বাসন্তী চাষ যা ফাল্গুন-চৈত্রে এর বীজ বোনা হতো আর গাছ কাটা হতো আষাঢ়-শ্রাবণ।’ তিনি আরও বলেন, ‘নীল চাষ হতো দুভাবে- নিজ আবাদি প্রথা ও রায়তি প্রথায়। নিজ আবাদি প্রথায় একজন নীলকর নিজের অধিকারভুক্ত জমিতে নিজের বীজ-সার-লাঙল ইত্যাদি নিয়ে ভাড়া করা শ্রমিকদের সাহায্যে নীল চাষ করত। তবে এই এলাকায় আসল চাষ হতো রায়তি প্রথায়। এ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য হলো নীলকরের কাছ থেকে দাদন নিয়ে কৃষকরা তার অধিকারভুক্ত জমিতে নীলচাষ করত ও সেই নীলগাছ নীলকরের দ্বারা নির্দিষ্ট দামে নীলকুঠিতে বিক্রি করতে বাধ্য থাকত।’ মূলত নীলগাছগুলো কাটার পর রায়ত গাড়ি বোঝাই করে নীল কারখানায় নিয়ে এলে কারখানার কর্মচারী ছয় ফুট লম্বা লোহার চেন দিয়ে এক এক আঁটি বাঁধার মতো করে সেগুলো মেপে নিত। তিনি জানান, মোহর গ্রামের নীলকুঠির কর্মচারীরা নীলগাছ সংগ্রহ করে নিয়ে বর্তমান রাজশাহীর দূর্গাপুরে পাঠাতো নীল তৈরির জন্য। আস্তে আস্তে মোহর গ্রামের সব জমি নীল চাষের আওতায় আসতে থাকে।

42258121_1929023000492733_5527501014485172224_n

বর্তমানে বাঘা পুকুরটি খননের উদ্যোগ নেওয়া হয় সেখানে দেখা যায় এই পুকুরের পশ্চিমপাড়ে রানী ভাবানীর সময়ে নির্মিত এক ঘাট। যা প্রায় পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। শুধু চুন সুরকি দিয়ে তৈরি ইটের পাটাতন অবশিষ্ট আছে। আবার এই পুকুরের পশ্চিম কোল ঘেঁষে স্থাপিত নীলকুঠিও আজ শুধু একটি দেওয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের পশ্চিম দিকের শুরুতেই কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ৫০০ বছরের তেতুল গাছ। গাছে বক, চরুই, টিয়া, ঘুঘুসহ বিভিন্ন দেশীয় পাখির বসবাস। বর্তমানে গাছের নিচে মুসলিম ধর্মের মানুষেরা বিভিন্ন মঙ্গল কাজে মানত করেন। আবার চৈত্র মাসের রোদে কৃষকরা এই গাছের নিচে বসে জিরিয়ে নেন। জনশ্রুতি আছে, এই গাছের কাছে কিছু চাইলে তা নাকি পূরণ হয়। তাই সকল সম্প্রদায়ের লোকই নাকি এই গাছকে প্রবিত্রতার প্রতিক হিসেবে গ্রহণ করেছে। এই গাছ সম্পর্কে গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি মো. মুসলেম মিয়া (৯২) বলেন, ‘এই তেঁতুল গাছ কবে আমাদের গ্রামে লাগানো হয় তা আমরা কেউ বলতে পারি না। কারণ আমি ছোটবেলাতেও এই গাছটিকে এমনই দেখেছি। তবে ধারণা করা যায় এই গাছের বয়স ৫০০ বা তার বেশি হবে।’

46510984_272977193421802_8999327271177158656_n

এই গাছের পাশেই মাটির উঁচু এক খন্ড জমি রয়েছে যেখানে আছে অনেক পুরাতন দুইটি পাথর। এই স্থানকে গ্রামের হিন্দু ধর্মের মানুষেরা প্রবিত্র স্থান হিসেবে মান্য করে। কিন্তু কবে কখন ও কোথা থেকে এই পাথর এখানে আসল সে সম্পর্কে কেউ নিদিষ্ট করে কিছুই বলতে পারেনি। এখানকার পাথরগুলো নিয়ে জনশ্রুতি আছে, দুটো পাথরের মধ্য একটি পাথর হঠাৎই কোন এক অজানায় অদৃশ্য হয়ে যায়। কখনও কখনও ফিরে আসে। এ প্রসঙ্গে গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্রী নিরেন সূত্রধর (৬৫) বলেন, ‘আমরা ছোট বেলা থেকেই দেখেছি যে এখানে দুইটি পাথর থাকে এবং এখানে বৈশাখ মাসে আমাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা পুজো করে। আবার মাঝে মাঝে দেখতাম একটি পাথর কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যেত। আমরা এখানে পুজো দিয়ে কোন কিছু চাইলে তা পূরণ হয়। গ্রামের কোন কোন পুকুর আছে যা খনননের দিন থেকে আজ অবধি কোনদিনও পানিশূন্য হয়নি।’

41894014_519111028534763_5472325047102210048_n

মোহর গ্রামের যুব সংগঠন“স্বপ্ন আশার আলোর”সদস্যদের দাবি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর গবেষণা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে গ্রামের সঠিক ইতিহান আনা ও গ্রামের ঐতিহাসিক নিদর্শন গুলো রক্ষা করা।

happy wheels 2

Comments