মানবতার নিবেদিত প্রাণ সেবিকা মিনা আক্তার

নেত্রকোনা থেকে পার্বতী সিংহ

প্রাকৃতিক ও জলবায়ুজনিত কারণে সৃষ্টি দুর্যোগের ফলে সহায় সম্বল হারিয়ে আমাদের দেশের অনেক পরিবার ভাগ্যান্নেষণে শহরমূখি হতে বাধ্য হচ্ছে। শহরে গিয়ে তাদের কেউ কেউ সচ্ছলতা পেয়েছে, কেউ কেউ কোন রকমে জীবনযাপন করছে, আবার কেউ কেউ বস্তিতে অনাহারে, অর্ধাহারে, বিনা চিকিৎসায় মানবেতরভাবে দিনাতিপাত করছে। আজ ভাগ্যান্নেষণে পরিবারসমেত শহরমূখি হওয়া অসংখ্য লোকদের ন্যায় এক নারীর জীবনযুদ্ধের গল্প সকলের সাথে শেয়ার করবো।

Exif_JPEG_420

অভাবের সাথে যুদ্ধ করে সফলতা পাওয়া এমনই এক নারী মিনা আক্তার (৪০)। স্বামী-মুসরিম উদ্দিন ও দুই সন্তানসহ চারজনের পরিবার মিনা আক্তারের। ৩৫ বছর পূর্বে আনুমানিক ১৯৮৩ সালে মিনা আক্তার সুনামগঞ্জ জেলা থেকে অভাবের তারণায় এতটুকু স্বাচ্ছন্দের আশায় গ্রাম থেকে পরিবার নিয়ে মিনার নেত্রকোনা শহরে পারি জমানো। শহরে আসার পর বাসা ভাড়া করে থাকার মত টাকা পয়সা তার ছিল না। টাকা না থাকায় কোন রকমে মাথাগোজার জন্য ঠাঁই হয় নেত্রকোনা শহরের রেল কলোনী বস্তিতে। স্বামী রিক্সা চালিয়ে যা উর্পাজন করত তা দিয়ে ক্ষুধা মেটানো দায় ছিল। তাই নিজেও অন্যের বাসা বাড়িতে কাজ করা শুরু করে। দুজনের রোজগারে কোন রকমে দিন চলছিল তাদের। নিজের কষ্টের সাথে সাথে অন্যের কষ্টও মিনাকে ভাবাতো। তিনি শুধুমাত্র নিজের সংসারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, অন্যের পরিবারের অর্থ কষ্টে নিজ থেকে সামর্থ অনুযায়ী আর্থিক কিংবা পরার্মশ দিয়ে সহায়তা করতেন। অন্যকে বিপদে-আপদে ও অভাবের সময় বিভিন্নভাবে তিনি সেই ৩৫ বছর আগে থেকেই করে আসছেন। বস্তিবাসীদের মধ্যে মারামারি, হানাহানি, ক্ষুধা, অভাব অনটন ও অপরিচ্ছন্ন মানবেতর জীবনযাপন তার ভালো লাগত না। এদের জন্য কিছু করার খুব ইচ্ছে তাকে তাড়িয়ে বেড়াত সব সময়। স্বামী-স্ত্রী দু’জনের আয়ে মিনার সংসারে ধীরে ধীরে স্বচ্ছলতা আসতে থাকে। স্বামী রিক্সা চালানো ছেড়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করে। ছেলেটি এসএসসি পাশ করে একটি কম্পানিতে চাকরি নেয়। মেয়েটির বিয়ে দেন একটি অবস্থ সম্পন্ন পরিবারে। নিজেদের স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ৮ শতক জায়গা লিজ নিয়ে সেখানে একটি টিনসেড পাকাঘর তৈরি করেছেন।

একসময় তাদের বস্তিতে উন্নয়নমূলক কার্যক্রম নিয়ে আসে কেয়ার বাংলাদেশ এবং গঠন করে বস্তি উন্নয়ন কমিটি। কমিটিতে যুক্ত হয়ে কাজ করার সুযাগ পেয়ে যায় মিনা আক্তার। তিন বছর কাজ করে কেয়ার বাংলাদেশ চলে গেলেও তার কাজগুলো থেমে থাকেনি। বস্তিবাসীদের জীবনমান ্উন্নয়নের নিজের সংসারে কম সময় দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়ে বস্তিবাসীদের অধিকার আদায়ে কাজ করে যেতে থাকেন মিনা। দরিদ্র ও অসহায় বস্তিবাসীদের জন্য বিনামূল্যে ঘর দেয়া, বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম, টিওবয়েল, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন, গর্ভবতী মায়েদেও স্বাস্থ্য সেবা, কুটির শিল্পের কাজের সুযোগ করে দেয়ার কাজ করতে থাকেন তিনি। এভাবে ধীরে ধীরে তিনি বস্তিবাসী সকলের প্রিয় মিনা আপা হয়ে উঠেন। বস্তির বিবাহযোগ্য মেয়েদের বিয়ে দেয়া, বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করা, রোগীদের চিকিৎসা পেতে সহায়তা করা, মৃত ব্যক্তির সৎকারের ব্যবস্থা করা মিনার দায়িত্ব হয়ে পড়ে। ঘুম থেকে ওঠে সংসারের কাজ কোন রকমে শেষ করে বস্তির প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ না নিলে তার ভালো লাগে না। নিজের পরিবারের মতো বস্তিবাসীর ভালো মন্দ দেখা তার দায়িত্ব হয়ে উঠে। বস্তিবাসির সুযোগ-সুবিধা আদায় ও বস্তির পরিবেশ উন্নয়নে, বস্তি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা পরিবর্তনে জন্য পৌরসভা, শিক্ষা অফিস, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য ওয়াপদা অফিস, ঋণ পেতে আশা, নারী প্রগতি ও উপজেলার বিভিন্ন অফিসে যোগাযোগ করেছেন বহুবার।

মিনা আক্তার বলেন, ‘৩৫ বছরে অনেক বস্তির অনেক পরিবর্তন আমি দেখেছি। আগে এ বস্তির নারীরা শুধুমাত্র বিড়ি তৈরির কাজ করত, আর পুরুষরা রিক্সা চালাত, কুলির কাজ করত, ঘরবাড়ী ছিল পলিথিন ও ছনের তৈরি, খাবার পানির জন্য অনেক দূরে যেতে হত। আর এখন নারীদের বাসাবাড়ি ও মেসে কাজের সুযোগ হয়েছে। বস্তিবাসীর ঘরবাড়ীর অবকাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে, গাছপালা বাড়েছে, বিভিন্ন ধরণের পেশার সুযোগ তৈরি হয়েছে (অটো চালনা, পিঠা তৈরী, ক্ষুদ্র ব্যবসা)। প্রতিটি পরিবারে আয় রোজগারের জন্য মানুষ বেড়েছে। কিন্তু বস্তিবাসিদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি, শিক্ষায় এখনো আমরা পিছিয়ে আছি। বসবাসের পরিবেশ এখনো অপরিচ্ছন্ন, খাবারের পানি সমস্যা, স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছি।’

এইসব সমস্যাগুলো দূর করে বস্তির নাম পাল্টানোই তার একমাত্র স্বপ্ন। বস্তিবাসিদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা পবির্তন করার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার বর্তমান যাত্রা শুরু।

happy wheels 2

Comments