নারীর চলার পথ হোক নিরাপদ ও বাধাহীন

নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা

নেত্রকোনা সদর উপজেলার আমতলা ইউনিয়নের একটি গ্রাম দেওপুর গ্রাম। এই গ্রামেই দেওপুর উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাত শত। নেত্রকোনার- সদর উপজেলা থেকে গ্রামের দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার। স্কুলের চারদিকের দূরবর্তী ১০টি গ্রামের শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসা যাওয়া করে। ছেলেরা সাইকেলে করে স্কুলে আসা যাওয়া করলেও মেয়েরা পায়ে হেটে যাতায়াত করে থাকে। যেখানে শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা সকল মৌসুমে শিক্ষার্থীদেরকে প্রচন্ড ধুলা ও কাদা মাড়িয়ে অনেক কষ্টে স্কুলে যাতায়াত করতে হয়। কোন গ্রাম থেকে ৫ কিলোমিটার কোন গ্রাম থেকে ৬ কিলোমিটার হেটে নেত্রকোনা মদনে যাওয়ার পাকা রাস্তা আসলেও সেখানে অধিকাংশ সময় কোন ধরনে যানবাহন (অটো) না পাওয়া গেলে আর এক কিলোমিটার রাস্তা হাটতে হয়। প্রচন্ড রোদ কখন ঝড়, বজ্রপাত মাথায় নিয়ে কোন রকম ছুটতে ছুটতে স্কুলে আসে নারী শিক্ষার্থীরা। ফলে মাঝে মাঝে সঠিক সময় স্কুৃলে আসতে যেমন সমস্যা হয়, সেই সাথে বাড়িতে ফিরতেও প্রায় সময় সন্ধ্যা হয়ে যায়। ফলে অধিকাংশ সময় আশানুরূপ রেজাল্ট যেমন করতে পারেনা তেমনি অভিভাবকরা থাকে এক ধরনে আতঙ্কে। সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের দেশ অনেক এগিয়েও গেছে। তারপরেও মেয়েদের নিরাপদ পথ চলার স্বাধীনতা এখনও সৃষ্টি হয়নি। ফলে স্কুলে এখন ঝরে পড়া শিক্ষার্থী যেমন রয়েছে সেই সাথে বাল্য বিবাহ এখন বন্ধ হয়নি।

03
সামাজিকভাবে আমাদের সমাজে ছেলেরা বড় হয় এক ধরনের নিয়মের ভেতরে। মেয়েরা বড় হয় আর এক সামাজিক বেড়াজালের মধ্যে । ছেলে বেলা থেকে প্রতিটি ছেলেকে যাতায়াতের সুবিধার জন্য সাইকেল কিনে দেওয়া হয়। যা মেয়েদের জন্য কখনো করা হয় না। ফলে এর সুখ সুবিধা সম্পর্কে তাদের ধারণাও থাকে কম। কিন্তু বর্তমানে দেওপুর গ্রামে কিছু মেয়ে সাইকেল চালাতে শিখলেও সাইকেলে চড়ে স্কুলে যাতায়াত বা পরিবারের কাজে বাইরে যেতে সাহস পায়না সামাজিক কারণে।

গ্রামের অধিকাংশ রাস্তা কাঁচা মাটির হওয়ায় একমাত্র সাইকেল ও মটর সাইকেল ছাড়া অন্য কোন যান চলেনা। স্কুলে আসা যাওয়ার নিরাপত্তাহীনতায় স্কুল থেকে ঝরে পড়া বন্ধে, সামাজিক বাধা দূরীকরণ, নারী শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পরিবেশবান্ধব নিরাপদ দ্রুতযান সাইকেল চালানোতে নারী শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধকরণে স্কুল কর্তৃপক্ষ উদ্যোগে ও বারসিক’র সহযোগিতায় সম্প্রতি মাঠে ১৫ জন নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে ধীরগতিতে সাইকেল চালানো প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।

04
প্রতিযোগিতা সম্পর্কে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইদুল হাসান খান বলেন, ‘আমার স্কুলে এতজন মেয়ে যে সাইকেল চালাতে পারে এত আমার জানাই ছিল না, ধনবাদ্য বারসিককে এ ধরনে একটি উদ্যোগ গ্রহণে আমাদের সহযোগিতা করার জন্য, আজকের পর থেকে আমি এবং আমার স্কুলের শিক্ষকরা মেয়েদের সাইকেল চালাতে উৎসাহিত করব।’
প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকারী ৭ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সামছুন্নাহার আক্তার রনি বলেন ‘প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে আমার খুব ভালো লাগছে আমি নিজে এত ভালো সাইকেল চালাই এটাতো আমার নিজেরও জানা ছিল না, আজকের এ প্রতিযোগিতা আমার নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগাতে সহায়তা করবে।’

এ সম্পর্কে স্কুলের সহকারী শিক্ষীকা শিল্পী রানি বলেন“ প্রথম বারের মতো আমাদের স্কুলে এধরনে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে , যার আরও আগে আয়োজন করার প্রয়োজন ছিল কারন আমাদের স্কুল একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুল স্কুলে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ার একটি অন্যতম কারণ যাতায়াত, সামাজি নিরাপত্তার অভাব সাইকেলের মত যানবাহনে চলে স্কুলে আসা যাওয়া করলে একদিকে যেমন মেয়েদের শারীরিক কষ্ঠ কমবে সেই সাথে নিজের মধ্যে সামাজিক বাধা ভেঙ্গে সামনে চলার আত্ববিশ্বাস সৃষ্টি হবে”।

05
প্রতিযোগিতা শেষে বারসিক’র পক্ষ থেকে বিজয়ীদের মধ্যে পুরষ্কার হিসেবে তুলে দেওয়া হয় মহা মূল্যবান বই। সকল সামাজিক বাধা দূর করে নারী, পুরুষের ভিন্নতা ভুলে পরিবার, সমাজ, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে নারীর চলার পথকে যেমন বাধামুক্ত করতে হবে সেই সাথে পরিবার সমাজ সকল ক্ষেত্রে নারী মত প্রকাশ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাই এমন একটি বহুত্ববাদী সমাজ যেখানে নারীরা পথ চলতে চলতে বার বার পিছনে তাকাবে না অচেনা আতঙ্কে।

happy wheels 2

Comments