চশমা ও মাস্ক কামারদের রোগবালাই কমিয়ে দিয়েছে

নেত্রকোনা থেকে রোখসানা রুমি
সকল পেশাবৈচিত্র্যের মানুষকে সাথে নিয়েই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। কাউকে পিছনে ফেলে নয়। নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার ফচিকা গ্রাম। গ্রামে একসময় ছিল জেলে, কামার, কুমার, মুচি, কৃষক, মাঝিসহ সকল পেশার জনগোষ্ঠীর সহাবস্থান। বর্তমানে ফচিকা গ্রামে ৩০০টি পরিবার ও ২০০০ জন লোক বসবাস করলেও কামারদের পেশা আজ বিলপ্তির পথে। ফচিকা গ্রামে বর্তমানে ৩০টি কর্মকার সম্প্রদায়ের পরিবার বসবাস করে। এই পরিবারগুলোর মধ্যেও ভিন্ন পেশায় যুক্ত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কেউ কেউ ওয়েল্ডিং ও মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপের আবার কেউ কেউ স্বর্ণকারের ও লোহালক্করের ব্যবসা করছেন।

আবার অনেক কর্মকার স্থানীয় ফচিকা বাজারে কামারের দোকান দিয়ে কেউবা আবার নিজ বাড়িতেই লোহার দা, কোদাল, খুন্তি, কাঁচি, ছেনি ইত্যাদি দৈনন্দিন ব্যবহার্য গৃহস্থালির হাতিয়ার তৈরি করে বিক্রি করেন। কর্মকারদের পেশা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ পেশা, যেকোন সময় দূর্ঘটনায় বড় ধরণের অঙ্গহানি ঘটতে পারে। ফচিকা গ্রামের এমন একজন প্রবীণ কর্মকার রয়েছেন, যিনি লোহা দিয়ে বিভিন্ন ধরণের গৃহস্থালি উপকরণ তৈরি করতে গিয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গ চোখে লেগে অন্ধ হবার পথে। আগুন ও ধোয়ার মধ্যে প্রতিদিন কাজ করে চোখের সমস্যার সাথে সাথে শ্বাস কষ্টের জন্য মৃত্যুও সাথে লড়াই করছেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে বিশ্রাম নিলে তো আর চুলোয় রান্নার হাড়ি চড়বেনা, তাই শরীরের এমন হাল হওয়া সত্বেও তিনি লোহা পিটনোর কাজ করছেন সংসারের খরচ লাঘবের জন্য।


গত দুবছর আগে বারসিক’র মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তায় গ্রামে স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক এক প্রচারণামুলক (স্বাস্থ্য ক্যাম্প) অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে আলোচনার মাধ্যমে এ পেশার জনগোষ্ঠীকে কর্মক্ষেত্রে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য মূখে মাস্ক পড়া এবং চোখে কালো চশমা ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়।


ফচিকা গ্রামের কর্মকার পরিবার ও কর্মকার সংগঠনের তথ্য থেকে জানা যায়, গ্রামের ১৪ জন প্রবীণ কর্মকার ব্যক্তি রয়েছেন, যাদের লোহার কাজ করতে গিয়ে চোখে লোহার স্ফুলিঙ্গ ছিটে গিয়ে অনেকেরই চোখে সমস্যা দেখা দিয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, এ পেশার লোকেরা লোহার কাজ করতে চোখে কোন ধরণের চশমা ও মাস্ক ব্যবহার করতেন না। আর্থিকভাবে দূর্বল এ বিষয়ে সচেতনতা না থাকায় চোখের চিকিৎসাও করাতে পারতেন না। সারাদিন পরিশ্রম করে তারা যে পরিমাণ টাকা রোজগার করেন তা দিয়ে তাদের কোন রকমে সংসারের খরচ চলে।


গত দুইবছর আগে বারসিক’র উদ্যোগে ১৪ জন কামার সদস্যকে চশমা ও মাস্ক কিনে দেয়া হয় তাদের চোখের নিরাপত্তার জন্য। তারপর থেকেই কামার সদস্যরা কাজের সময় চোখে চশমা ব্যবহার করেন। চোখে চশমা ব্যবহারের ফলে এখন কামার সদস্যরা আরামের সাথে কাজ করতে পারছেন। চোখের সমস্যাগুলো কম দেখা দিচ্ছে। যারা নবীন হিসেবে কাজ শুরু করেছেন তারা চশমা ও মাস্ক ব্যবহারের ফলে কোন রকম অসুবিধা অনুভব করছেন না।


সাধারণত তারা যেসব স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভোগেন তার মধ্যে অন্যতম হল-প্রবীণ বয়সে শ্বাসকষ্ট এবং চোখের জ্যোতি কমে যাওয়া। প্রবীণ বয়সে পরিশ্রমের কাজকর্ম তেমন করতে পারেন না, ফলে এসময় তাদের কাছে তেমন কোন টাকা পয়সা না থাকায় তারা সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে পারেন না।


গ্রামের প্রবীণ নারী উজ্জ্বলা কর্মকার বলেন, ‘আমার স্বামী লোহার কাজ করতে গিয়ে চোখে লোহার কটি (স্ফুলিঙ্গ) পড়ে প্রায় ২০ বছর যাবত চোখে দেখে নাই। আমার কাছে টাকা না থাকায় তাকে কোন চশমা কিনে দিতে পারি নাই। স্বামী মারা গেছে প্রায় ৫ বছর হয়, স্বামী মারা যাওয়ার কষ্টে আমি আজও নীরবে কান্দি। বারসিক সকল সদস্যকে চমশা কিনে দেয়ায় আমাদের মাঝেও সচেতনতা আসছে যারা কাজ করে তারাও আস্তে আস্তে রোগ থেকে রেহাই পাচ্ছেন।’

happy wheels 2

Comments