সাম্প্রতিক পোস্ট

মাছের নিরাপদ প্রজননের জন্য অভয়াশ্রম তৈরি

হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে সত্যরঞ্জন সাহা

মানিকগঞ্জ জেলার শিবাল ও হরিরামপুরের উপর দিয়ে বয়ে যায় পদ্মা নদী। বিশেষ করে নিচু এলাকা হওয়ায় এ জেলার খাল-বিল-নদীতে একসময় প্রচুর ছিলো। এলাকার মাছ চাহিদা পূরণ করে এই এলাকার মাছ অন্য এলাকাতেও রপ্তানি করা হতো। কিন্তু কালক্রমে খাল-বিল-নালাসহ নিচু এলাকাগুলো ভরাট হওয়া এবং রাসায়নিক কৃষির কারণে এলাকায় মাছবৈচিত্র্য অনেক কমে গেছে। এই প্রসঙ্গে হরিরামপুরের গৌতম রাজবংশী কান্ঠাপাড়া (৬২), “আগে খাল-বিল-নদীতে মাছ ছিল প্রচুর। খাবারের কোন কিছু নাই নদীতে জাল দিয়ে কয়েকটি খেউ দিয়ে মাছ ধরে বাড়িতে এনে বাড়িতে দিত। তাজা জেতা মাছের তরকারি আউশ ধানের (কালা মানিক ধান) ভাত দিয়ে খাইতে কি মজাই লাগত। সেই দিন কোথায় গেল।” তিনি বলেন, “তুমাদের কাছে এই সব কথা বললে এখন আর বিশ্বাস হবে না। আগে অনেক জাতের মাছ দেখতাম, বর্তমানে কিছু জাতের মাছ একেবারে নেই বলেই চলে! এখন নদী-নালা-খাল-বিলে মাছ খুবই কম, পুকুরের পালা মাছ ছাড়া বাজারে মাছ নেই। পালা মাছ, সার বিষ দেওয়া শাক-সবজি ও চালের ভাত খেয়ে মানুষের অসুখ বাড়ছে, মানুষের শক্তি কমে যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে তুমরাই দেখতে পারবা পুকুরের পালা মাছ ছাড়া, খাল-বিল-নদীতে কোন মাছ পাইবা না।” তার মতে, মাছ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো দিন দিন পানি কমে যাওয়া, চাষাবাদে সার ও বিষের ব্যবহার বৃদ্ধি।

Presentation1
বেশি দিনের আগের কথা নয় মানিকগঞ্জ এলাকার নদী, খাল-বিল-নালাগুলোতে বাইলা, টেংরা, শিং, গুলসা, বাইম, গচি, রয়না, টাটকিনি, কাইকা, চিংড়ি, বোয়াল, আইড়, টাকি, গুতুম, পুটি, খইলসা, মলা, চান্দা, চেলা, বাগাইর, বাঁচা, রিটা, বেতরাংঙ্গা, মাগুর, কালি বাউশসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ ছিল। নদীর পানি বেশি থাকায় এবং রাসায়নিক উপাদান কম থাকায় এসব মাছের প্রজনন ও বিচরণে কোন সমস্যা ছিলো না। তবে ডিমওয়ালা মাছ নিধনসহ অন্যান্য কারণে এসব মাছ আজ কদাচিৎ পাওয়া যায়।এই প্রসঙ্গে হরিরামপুরের পাটগ্রামচরের ছিদ্দি মোল্লা (৬০) বলেন “বর্ষার সময় জ্যৈষ্ঠ থেকে আষাঢ় মাসের নতুন পানিতে মাছ চলাচল করে বেশি। তখন জেলেসহ এলাকার লোকজন বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরে। এসকল মাছের অধিকাংশগুলোতে ডিম থাকে। এসব ডিমওয়ালা মাছ নিবিচারে ধরার জন্য জলাশয়ে মাছ কমে যাচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “পুকুরে সেচ দিয়ে, বিষ প্রয়োগ করে, বেড়া দিয়ে পোনা মাছসহ সব ধরনের মাছ ধরার কারণে দিন দিন জলাশয়ে মাছের পরিমাণ একেবারে কমে গেছে। যদি এভাবে মাছ ধরা হয় তাহলে পরবর্তীতে জলাশয়ে আর মাছ পাওয়া যাবে না। এজন্য আমাদের সবাইকে ডিমওয়ালা মাছ না খাওয়ার অঙ্গীকার করতে হবে।”

মানিকগঞ্জ এলাকার হারিয়ে যাওয়া মাছবৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনার জন্য সম্প্রতি হরিরামপুর উপজেলার দিয়াবাড়ি বিল ও কান্ঠাপাড়া বাজার সংলগ্ন ইছামতি নদীর ৪০ বিঘা জলাশয়ে মাছ সংরক্ষণের জন্য অভয়াশ্রম করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এলাকার মৎস্যজীবীদের নিয়ে মাছ সংরক্ষণের জন্য এই উদ্যোগটি সরকারিভাবে গ্রহণ করা হয়। হরিরামপুর উপজেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা মজিবউদ্দিন চৌধুরী জানান, জেলা মৎস্য অফিসের অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ এলাকার জনগণের দারিদ্র বিমোচন ও জীবিকা নির্বাহ নিশ্চিতকরণ (২য় সংশোধিত) প্রকল্পের সহযোগিতায় মাছবৈচিত্র্য বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য মূলত এই মৎস্য অভয়াশ্রম করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

প্রসঙ্গত এলাকায় অনেকে মাছ ধরার জন্য ব্যবহার করেন ঝাকি জাল, ঠেলা জাল, বাঁশের তৈরিকৃত বোচকা, চাই, কাইটা, ছোট ছিদ্র জালসহ নানা উপায়ে। এতে করে প্রজনন মৌসুমে মাছ কোথাও ডিম পাড়তে পারে না, ফলে মাছের বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হয়। তবে ঘোষিত এই অভয়াশ্রমে কেউ কেউ মাছ ধরতে পারবে না। নির্ধারিত অভয়াশ্রমে মাছ ধরাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য সেখানে লাল পতাকা টানানো আছে। এই অভয়াশ্রমে মাছ বংশবিস্তার করবে ও বৃদ্ধি পাবে।

আমরা মনে করি উদ্যোগটি অবশই প্রসংশনীয়। তবে এই উদ্যোগ যাতে সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। এই দায়িত্ব শুধু সরকারের বা  সংশ্লিষ্ট মৎস্য বিভাগ নয়; এটি আমাদের সবার বিশেষ করে মানিকগঞ্জ এলাকার প্রতিটি বাসিন্দাদের দায়িত্ব।

happy wheels 2

Comments