বীজ বিদ্যাপীঠ এর শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপদ্ধতি

বীজ বিদ্যাপীঠ এর শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপদ্ধতি

ভারতের দেরদুনের বীজ বিদ্যাপীঠ থেকে ঘুরে এসে মানিকগঞ্জ থেকে বাহাউদ্দীন বাহার

 

‘নবধান্যিয়া’ শব্দের অর্থ হচ্ছে নয়টি শস্য বীজ। নব=৯ আর ধান্যিয়া= শস্যবীজ। এটি একটি জীব বৈচিত্র্য খামার (Bio-Diversity  Firm)। একই সাথে এটি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের-নাম ‘বীজ বিদ্যাপীঠ’ ইংরেজিতে বলা হয় ‘Earth University’। এই প্রতিষ্ঠানটির দাবি অনুযায়ী এটি একটি অর্গানিক বা জৈব কৃষি শিক্ষার আদর্শ স্থান।

বীজ বিদ্যাপীঠ এর শিক্ষার্থী মূলত চার ধরনের।

ক) ইন্টার্ন- যাদেরকে কমপক্ষে ১ মাস বিদ্যাপীঠে অবস্থান করতে হবে।

খ) বিভিন্ন কোর্সের শিক্ষার্থী

গ) স্বেচ্ছাসেবক

ঘ) দর্শনার্থী- যারা এক মাসের কম বিদ্যাপীঠে অবস্থান করে।

এই চার ধরনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম দুই ধরনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট রুটিন রয়েছে। শিক্ষার ধরণ সম্পূর্ণ হাতে কলমে। শিক্ষার্থীদের আবাসিক অবস্থান বাধ্যতামূলক। দিন শুরু হয় সকাল ৬ টায়। ৬টায় থেকে ৭টা পর্যন্ত মেডিটেশন। ৭টায় ভেষজ চা। এরপর সকাল ৮টা পর্যন্ত বিরতি। এর মধ্যেই অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ করতে হবে। কেননা ৮ থেকেই মূলত শিক্ষার্থীদের ব্যস্ততা শুরু হয়। সকাল ৮ থেকে ৮ টা ৩০ পর্যন্ত সকালের নাস্তা। ৮টা ৪৫ থেকে মর্নিং গ্যাদারিং(সকালের স্মাবেশ)। এই অধিবেশনে অনেক গুলো কাজ করা হয়। প্রথমত, একটি উক্তি এবং সেটির অন্তর্নিহিত বক্তব্য দিয়ে শুরু হয়। তারপর একটি খেলা কিংবা কাজ; যেটি সবাই মিলে যেন করতে পারে। এই অধিবেশনের সবশেষে দিনের সবার একটি প্রার্থনা বা আশা প্রকাশ করা হয়। যেমনঃ আজ যেন বৃষ্টি হয়, গরম যেন কম পড়ে, প্রভৃতি।

সকাল ৯ টায় শুরু হয় ‘শ্রমদান’। এই শব্দটি মহাত্মা গান্ধীর জীবন ও দর্শন থেকে নেয়া। ‘শ্রমদান’ শব্দের অর্থ হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা। বীজ বিদ্যাপীঠের কোন একটি অংশকে সবাই মিলে পরিষ্কার করার নামই হচ্ছে ‘শ্রমদান’। এটি অবশ্যপালনীয় একটি কাজ। ১০টা থেকে ১২ টা মূলত হাতে-কলমে বীজ বিদ্যপীঠের খামারে কাজ করা। মাঝখানে ১১টায় রয়েছে চা অথবা শরবতের বিরতি। এই ২ ঘণ্টা কাজ করতে হবে খামারে কীভাবে জৈব উপায়ে চাষাবাদ করা যায় সেই জিনিসগুলো। কোন দিন, জমি প্রস্তুত, কোন দিন বীজ সংগ্রহ আবার কোন দিন চারা বা বীজ বপন। এটা শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে করতে হয় না। খামারের কর্মচারীরা যেদিন যে কাজ করে সেই কাজে সহযোগিতা এবং শিখে নেওয়াই এই অধিবেশনের মূল লক্ষ্য। তবে প্রতিদিন যে খামারের কাজে সহযোগিতা করতে হয় এমনটা নয়। নিজে নিজে শিক্ষার্থীদের কৃষি কাজ করার জন্য রয়েছে আলাদা জায়গা; যার নাম “জ্ঞান গার্ডেন”।

day schedule‘জ্ঞান গার্ডেন’ একটি নাশপাতি গাছকে ঘিরে গোলাকার একটি জায়গার নাম জ্ঞান গার্ডেন। এখানে হাতে-কলমে এবং পঠিত বিষয় শিখে প্রয়োগ করার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করা হয় বলে এই বাগানের নাম জ্ঞান গার্ডেন। এই বাগানের কোন কাজই খামারের কর্মচারী করেন না। এখানের সব কাজই করতে হয় এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীদের। মাঠ প্রস্তুত থেকে শুরু করে বীজ বপন এমনকি ফসল উত্তোলন করে বিদ্যপীঠে আগত বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের। একটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা হয়তো বীজ বপন করে গেলো আর এক ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এসে হয়তো সেই ফসল উত্তোলন করছে। শিক্ষার্থীরা এই বিদ্যাপীঠ ত্যাগ করলেও ফোনে কিংবা বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে খবর রাখে তাদের জ্ঞান গার্ডেনের ফসলের।

১২ টা থেকে ১টা পর্যন্ত গোসল এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ করার সময়। ১টা থেকে ২ টা দুপুরের খাবার। ২টা থেকে ৩টা বিরতি। ৩টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত ক্লাস বা তাত্ত্বিক আলোচনা। এই সময়ে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করা হয়।

৫টায় চা বিরতি এবং ৫ টা থেকে ৮টা পর্যন্ত ফ্রি সময়। এই সময় খেলাধুলা এবং অন্যান্য বিনোদন এর জন্য। ৮টায় রাতের খাবার। ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত আড্ডা, আলোচনা, পড়াশুনা। তবে রাত ১০ টা থেকে পরদিন সকাল ৬টা হচ্ছে নিরব সময়। এই সময় রুমে বসে পড়াশুনা কিংবা অন্যান্য কাজ করা যাবে। তবে অন্য কারো অসুবিধা হয় এমন কোন কাজ করা যাবে না।

এই রুটিন পড়ে মনে হতে পারে এখানে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ-পদ্ধতি কোথায়? বীজ বিদ্যাপীঠ ক্লাস রুমভিত্তিক শিক্ষা দানের চেয়ে হাতে-কলমে এবং উন্মুক্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে শিখুক। তাহলে তাদের মধ্যে এই জানার প্রভাবটা গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী হবে। আপনি হয়তো দুপুরের খাবার খেতে খেতে কারো সাথে জৈব কৃষির বাজারজাতকরণের বিষয়গুলো নিয়ে কথা বললেন। কিংবা বিকালের চা খেতে খেতে জেনে নিলেন বীজ বিদ্যাপীঠের ইতিহাস এবং দর্শন।

সপ্তাহের কোন দিন কোন বিষয়গুলো নিয়ে গুরুত্ব দেয়া হবে সেটিও নির্ধারণ করা আছে এখানে। যেমন ভারতে সপ্তাহ শুরু হয় সোমবারে। আর সোমাবারে শেখার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া হবে চিকিৎসা (ভেষজ), মঙ্গলবার বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, বুধবারে দক্ষতা বিনিময়(আপনি হয়তো কোন গান, কিংবা ভালো হাতের কাজ পারেন সেটি সবার সাথে শেয়ার করবেন), বৃহস্পতিবার ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী, শুক্রবারে সবাই মিলে রান্না করা, শনিবার মুলত শিক্ষার্থীদের নিজের জন্য (জামাকাপড় পরিষ্কার, নিজের ঘর গোছানো, প্রভৃতি)। আর সবচেয়ে মজার দিন হচ্ছে রবিবার-এদিন শুধুই বিনোদন। ওখনাকার ভাষায় “সানডে-ফানডে”।

Rutine

এখানকার মূল বিশয়ভিত্তিক আলোচনার জন্য হয়তো নির্ধারিত একজন আলোচক থাকে; তাছাড়া ওখানের সবার কাছ থেকে আপনি শিখতে পারেন। যিনি জমি চাষ করেন তার কাছ থেকে শিখে নেন কীভাবে জমি প্রস্তুত করতে হয়। যিনি বীজ সংরক্ষণকারী তার কাছ থেকে শিখে নেন বীজ সংরক্ষণ এর বিষয় গুলো। পাশাপাশি এখানে রয়েছে পাঠাগার-আপনি ইচ্ছে হলে সেখানে বসে পড়ে নেন যে বিষয়টি সম্পর্কে আপনি বিস্তারিত জানতে চান।

শেখাটা এখানে তাই পড়া এবং শুনা একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি চর্চা, প্রতিদিনকার নিত্যনৈমিত্তিক কাজের মধ্য দিয়ে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করার বিষয়। আপনি হয়তো কিছু খাচ্ছেন-খাওয়ার মধ্য দিয়ে জেনে নিন কি খাচ্ছেন? কেন খাচ্ছেন? কি খাওয়া উচিত? হয়তো চিন্তা করছেন-এমন কোন চিন্তা করুন যেটি একজন কৃষক করে। পানি খাচ্ছেন খান যেভাবে খাওয়া উচিত-মাটির পাত্রে; বোতলজাত নয়।

 

 

happy wheels 2