বায়োমাস : বাংলাদেশের জ্বালানি সংস্কৃতির প্রধান উৎস

:: মো. এরশাদ আলী, লেখক ও গবেষক ::

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশিরভাগ দেশেই বায়োমাস জ্বালানি গ্রামীণ পরিবারের স্থানীয় উৎস হিসেবে গুরুত্বপর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশই বায়ো শক্তির ব্যবহারকারী পাশাপাশি উৎপাদনকারীও। বাংলাদেশেও বেশিরভাগ গ্রামীণ পরিবারগুলো শক্তির প্রাথমিক উৎস হিসেবে বায়োমাস ব্যবহার করে। বিভিন্ন সময় খেয়াল করলে দেখা যায়, প্রতিবেশকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ধরনের জ্বালানি রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়, যেমন নাচোল উপজেলার নিজামপুর ইউনিয়নের আবাদি/অনাবাদি জমিতে এক ধরনের আগাছা গাছ লক্ষণীয় যা স্থানীয়ভাবে ঝান্টি বা জঙ্গল গাছ নামে পরিচিতি। কোন আবাদ ছাড়াই এই গাছগুলো জমিতে জন্মায়। স্থানীয় জনসাধারণের ভাষ্যমতে, জ্বালানি চাহিদার বেশ একটি বড় অংশ ঝান্টি পূরণ করে থাকে। তবে দীর্ঘদিন ঝান্টি ব্যবহার করছে এমন পরিবারের সাথে কথা বলে দেখা যায়, ঝান্টি ব্যবহারের স্বাস্থ্যগত কিছুটা ঝুঁকি রয়েছে। যারা এলার্জিতে ভোগেন তারা এই আগাছা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করলে চর্ম রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে বা হয়। এছাড়াও গবেষণাধীন এলাকাতে বায়োমাস ব্যবহারের ফলে যে সকল স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয় যা তথ্যদাতারা উল্লেখ করেছেন যেমন- সাধারণত পাতা, ডালপালা সংগ্রহ করার জন্য শিশু ও নারীরা বেশি অংশগ্রহণ করে। শিশু ও নারীদের ক্ষেত্রে চোখে চুলকানী, জ্বালাপোড়া ও হাতে পায়ে ফুসকুড়ি উঠাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রদাহ দেখা দেয়। রান্নার সময় বায়োমাস ব্যবহারের ফলে প্রচুর পরিমাণ ধোঁয়া হয় ফলে ধীরে ধীরে শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে বাঁশের কঞ্চি, খড়, কাশিয়া, ভূট্টা গাছ, কয়লা, ধঞ্চিয়া, কলমি, পাতা, গমের শীষ, শুকনো ঘাস, তুষ (ধানের খোসা) এবং বিভিন্ন প্রকার গাছের পাতা, ধানের গুড়ার অংশ, সরিষার গাছ, শুকনো বীজপত্র, গাছকে লাকড়ি বা খড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায়। যদিও রান্নার কাজে ব্যবহৃত জ্বালানির এইসব উৎসগুলো টাকা দিয়ে ক্রয় করতে হয় না। তবে বর্তমানে সংগ্রহের ক্ষেত্রে নানাধরনের প্রতিবন্ধকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জয়পুরহাট এর উদাহারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। জয়পুরহাট অঞ্চলে আখ চাষ ভালো হয়। আখের ছোবরা ও শুকনো খোলস অনেক সহজলভ্য হওয়ার কারণে স্থানীয় জনগণ এগুলো রান্নার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহর করে থাকে। তবে বর্তমানে চিনিকল বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকায় সহজে আখের ছোবরা ও শুকনো খোলস রান্নার জন্য সংগ্রহ করতে পারছে না। একই ধরনের সমস্যার দেখা যায় ভূরঙ্গামারী, টেকনাফ ও শ্যামনগর এলাকায়। আজ থেকে ২০ বছর আগেও এসব এলাকায় বাঁশঝাড় থেকে কঁঞ্চি, পাতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে বাঁশের মোথা সংগ্রহ করা তাদের জন্য সহজ ছিল। তবে বর্তমানে এগুলোর বাজার মূল্য তৈরি হওয়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী সহজে সংগ্রহ করতে পারছে না। উল্লেখ্য, বর্তমানে ইট ভাটাগুলোতে বাঁশের মোথার ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় এর বিক্রয় মূল্য তৈরি হয়েছে। এসব অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই পাহাড় ও বন থেকে সংগৃহীত কাঠ, বর্ষাকালে নদী দিয়ে ভেসে আসা গাছ, গাছের ডালপালা সংগ্রহ করে রেখে পরবর্তীতে রান্নার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করত। কিন্তু অধিক জনসংখ্যার প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অধিক নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাওয়া এবং আইলার মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগের ফলে বর্তমানে জ্বালানি সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে

[su_box title=”শ্রীমঙ্গলের নিরালা খাসি পুঞ্জির” style=”glass”]বিধবা লাউ তালাং (৫৬) এর দৈনিক রান্নার কাজে ব্যবহৃত লাকড়ি-পাহাড় থেকে সংগ্রহ করতে ব্যয় হয় প্রায় ৪ ঘণ্টা। সংগৃহীত পাহাড়ি লাকড়ি বাজারে বিক্রি করে যে টাকা পান তা দিয়েই লাউ তালাং কেরোসিন এবং আলো ও রান্নার কাজে ব্যবহৃত অন্যান্য জ্বালানি উপকরণ কেনেন। তালাং এর চুলা জ্বালানোর জন্য কেরোসিন বাবদ খরচ হয় ৩ টাকা এবং কুপিবাতি জ্বালানোর কেরোসিন বাবদ খরচ হয় ১০ টাকা। এখানে জ্বালানি সংগ্রহকারীর শ্রমকে আর্থিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়নি। লাউ তালাং আক্ষেপ করে বলেন, “বর্তমানে পাহাড়ে গাছ কমে যাওয়া এবং বনবিভাগের নানান নিষেধাজ্ঞার কারণে পাহাড়ের ঝরে পড়াপাতা ও ডাল সংগ্রহ করাও তার জন্য কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে[/su_box]

সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতি দেখতে পাওয়া যায় বাংলাদেশের চর এলাকাগুলোতে। চর এলাকায় রান্নার জন্য জ্বালানি তেমন কোন সমস্যা দেখা যায় না। চর এবং আসে পাশের এলাকার রান্নার জন্য জ্বালানির প্রধান উৎস এতদ্বাঞ্চলের চরগুলো। চরাঞ্চলের লাকড়ির সরবারহের উপর রান্নার জ্বালানির দাম উঠানামা করে। সরবারহের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো যোগাযোগ ব্যবস্থা। বর্ষাকালে নৌকার অভাবে, শীতকালে নদী শুকিয়ে যাওয়ায় সুবিধামতো যানবাহনের অভাবে জ্বালানি বাজারে আনা সম্ভব না হলেই দাম বেড়ে যায়। অটোরাইস মিলগুলোতে জ্বালানি হিসেবে খুব বেশি পরিমাণে খড় ও ধানের তুষ ব্যবহারের ফলে, এর চাহিদা ও দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠির সংগ্রহ ক্ষমতার মধ্যে থাকা বায়োমাস জ্বালানিগুলো এখন ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। বিশেষ করে কার্তিক, অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে জ্বালানি সঙ্কট আরও বেড়ে গেছে। এ সময় জ্বালানি ক্রয় করে ব্যবহার করতে হয়। অন্যদিকে রাজধানী ঢাকার চিত্র ভিন্ন। ঢাকায় জ্বালানি সংকটের চেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সক্ষমতার অভাব প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করা যায়। দরিদ্র জনগোষ্ঠি বিশেষ করে বস্তি এলাকায় বসবাসকারী বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত কম আয়ের কারণে জ্বালানি সংকটে কাটান। স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি থাকলেও পর্যাপ্ততার কারণে ঢাকা শহরের বেশিরভাগ বস্তি এলাকায় রান্নার জন্য পোশাক কারখানার টুকরো কাপড় ব্যবহার করে থাকে।

বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণে জনগোষ্ঠির জ্বালানি চাহিদা নিবারণে বায়োমাস জ্বালানি বিশেষত ধানগাছ, গোবর, গাছের ডালপালা, লতা-পাতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু যেকোন গাছ জন্ম নেবার জন্য প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। আবার গাছ বৃদ্ধি ও পশুর জীবন ধারনের জন্যও প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশ প্রচুর নদীর সমন্বয়ে অবস্থান করছে। কিন্তু সবগুলো নদীই পানি শূন্যতার কারণে বাংলাদেশের পানির চাহিদা পূরণে নদীগুলো তেমন কোন ভূমিকা রাখছে না। বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এবং নদীতে পানি না থাকার দরুণ বৃক্ষরাজির পরিমাণ ক্রমশ কমছে। ফলে বায়োমাস হিসেবে ব্যবহৃত জ্বালানি সংকটের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। এছাড়া গ্রামীণ জ্বালানি উৎসগুলো দিনে দিনে কমে যাওয়ায় গ্রামীণ জ্বালানিতে দরিদ্র মানুষের প্রবেশাধিকার সংকুচিত হচ্ছে। বর্তমানে জ্বালানির জন্য গ্রামীণ জনগণকে কোনো না কোনোভাবে বাজারের উপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। আর এভাবে দৈনন্দিন ও বার্ষিক আয় রোজগারের একটা বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে জ্বালানি শক্তির ক্রয়খাতে যা অনেকসময়ই গ্রাম কি শহরের বস্তি এলাকার দরিদ্র জনগণের জন্য একটা চিন্তার বিষয়।

happy wheels 2

Comments