সফি নকরেক এর জীবন সংগ্রাম

কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে গুঞ্জন রেমা

মানুষের জীবন খুবই বৈচিত্র্যময় আর তা সরলরেখার মতো চলে না; চলে একেবেঁকে নানানভাবে। এমনই এক জীবন কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুরা ইউনিয়নের মনতলা গ্রামের গারো আদিবাসী সফি নকরেক-এর। আর দশ জনের সংসারের মতই ছিল তার সুখের সংসার। হঠাৎই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে না-ফেরার দেশে চলে যান তার স্বামী। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তার বিধবা জীবনের শুরু। আমাদের সমাজে একজন বিধবার জন্য যে সম্মান আর সহযোগিতা থাকা দরকার তা নেই। তবুও থেমে থাকেননি সফি নকরেক। তার জীবন সংগ্রাম তিনি চালিয়ে গেছেন নানান ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে।

সফি নকরেক এর জমি জিরাত বলতে শুধু ভিটে মাটিই সম্বল। স্বামী মারা যাওয়ার পর দু’টি সন্তানকে নিয়ে কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না তিনি। অন্যের বাড়িতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করে সন্তানদের দু’বেলা ভাত জোগাতে খুব কষ্ট হতো তার। অনেকদিন নিজে না খেয়েও ছেলেমেয়েকে খাওয়াতেন। এরপর তিনি নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেন দিন মজুর হিসেবে কাজ না করে ব্যবসা করবেন। কিন্তু কি ব্যবসা করবেন সেটাও বুঝতে পারছিলেন না।

dsc01156

তারপর একজন বাঙালির দেখাদেখি গ্রামে ঘুরে ঘুরে শাকসবজি ফলমূল কিনে বাজারে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন। পুঁজি না থাকাতে গ্রামের পরিচিত মানুষদের কাছ থেকে বিভিন্ন ফল ও শাকসবজি বাকিতে কিনে নিয়ে বাজারে বিক্রি করা শুরু করেন। বিক্রি করে যেটুকু লাভ পেতেন সেটা দিয়েই সংসার চালাতেন। এভাবে ধীরে ধীরে কিছু টাকা জমাতে শুরু করেন। টাকা জমিয়ে গ্রাম ও বাজার থেকে শাকসব্জি, বিভিন্ন ফল কিনে বাজারে বিক্রি করা শুরু করেন। এভাবে ব্যবসা করে দু’টি সন্তানকে নিয়ে কোন রকমে বেঁচে থাকার পথ খুঁজে পান সফি নকরেক।

এই কাজ বেছে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি দিন মজুর হিসেবে কাজ করলে সব সময় কাজ পাওয়া যায় না, আর যেদিন কাজ না পাই সেদিন না খেয়ে থাকতে হয়। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি কম আয় হোক তবু যেন নিয়মিত আয় হয়। সেজন্যই এই কাজটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
লেঙ্গুরা বাজারে তিনিই একমাত্র নারী যিনি পুরুষের পাশাপাশি ভ্রাম্যমান সবজির দোকান দিয়ে আজও টিকে আছেন। এমনকি নারী হয়ে পুরুষদের পাশাপাশি ব্যবসা করছেন দীর্ঘদিন যাবৎ। শুরুতে সমস্যা হলেও আস্তে আস্তে সে সমস্যা কাটিয়ে নেন তিনি। বর্তমানে অনেকে তাকে সহযোগিতা করেন বলে জানান। তিনি যেখানে দোকান নিয়ে বসেন এর পাশেই একটি মনোয়ারী দোকান আছে। সে দোকানেই অবিক্রিত মালামালগুলো রেখে যান। পরে যখন আবার দোকান খোলেন তখন ওখান থেকে বের করে দোকান সাজান।

তিনি জানান, ক্ষুদ্র মূলধন দিয়ে ক্ষুদ্র দোকান দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। সেই সাথে মেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। ছেলেটি মায়ের এমন হাড়ভাঙ্গা কষ্টকে সহ্য করতে না পেরে অভাবের তাড়নায় লেখাপড়া ছেড়ে ভালুকার এক মৎস খামারে কাজ করেছে। এখন ছেলেও প্রতিমাসে এক দেড় হাজার টাকা পাঠাচ্ছে। সেই টাকা থেকে যেটুকু লাগে সেটুকু সংসারে খরচ করে বাকি টাকা দোকানের কাজে লাগাচ্ছেন।
ক্ষুধা, দারিদ্র, অসহায়ত্ব সব কিছু ধীরে ধীরে কাটিয়ে ওঠার এক অসীম সাহসিকতার প্রতীক সফি নকরেক। কষ্টগুলো একে একে কাটিয়ে সন্তান দু’টিকে দু’বেলা খাবার দিতে এখন আর আগের মত দুশ্চিন্তা করতে হয় না তাকে। এখন তার বড় স্বপ্ন মেয়েকে লেখাপড়া ও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা।

happy wheels 2