হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির ঐতিহ্য ধানের গোলা

আসাদুল ইসলাম, সাতক্ষীরা থেকে

‘গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ’-বাক্যটি বাঙালি ঐতিহ্যের পরিচায়ক। আর এই কথাটির মাধ্যমেই পরিচয় মিলতো গ্রাম বাংলার গেরস্তদের। কিন্তু কালের গর্ভে যেন হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালি ঐতিহ্যের প্রতীক ‘ধানের গোলা’।
একটা সময় ছিলো যখন সমাজের বিত্তশালী নির্ধারণ হতো কার কতটা ধানের গোলা তা দেখে। এমনকি বিয়ের জন্য পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের সময়ও কনে বা বরের বাড়িতে ধানের গোলা আছে কিনা তা দেখতো অভিভাবকরা। যা এখন কল্প কাহিনীতে পরিণত হয়েছে।

উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণের জন্য বাঁশ, বাঁশের বাতা ও কুঞ্চি দিয়ে বাড়িতে গোল আকৃতির গোলা তৈরি করতো গেরস্তরা। এই গোলা রাখা হতো বাড়ির উঠানের উঁচু কোন স্থানে। কোন কোন ক্ষেত্রে পাকা পোতা তৈরি করে তার উপরে বসানো হয় গোলা। আর তার ছাউনি হিসাবে বিচলী, খড়, গোলপাতা বা টিন ব্যবহার করা হয়। এক একটা গোলা তৈরিতে খরচ হতো ১০-৩০ হাজার টাকা। এখন গোলা বানানোর খরচ আরও বেশি। আগের মতো গোলা তৈরির জন্য অভিজ্ঞ কারিগরও পাওয়া যায় না। তবে, বর্তমানে ফসল সংরক্ষণে গেরস্তদের আর গোলা বানাতে দেখা যায় না। তাই আগে যেগুলো ছিল, তাও আজ বিলুপ্তির পথে।

pic-1

গোলার ব্যবহার ছিল বহুমাত্রিক। গোলার নিচের অংশে পাকা জায়গায় বাড়ির মহিলারা হাঁস-মুরগি পালন করতো। কেউ কেউ রাখতো ছাগল ও ভেড়া। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক ধানের গোলাতে গেরস্তরা সারাবছর উৎপাদিত ধান, গম, সরিষাসহ অন্যান্য ফসল মজুদ করে রেখে দিতো। ব্যবহার করতো সারা বছর। কিন্তু আধুনিকতার ছোয়ায় সেই ঐতিহ্য আজ আর নেই।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার রাজার বাগান গ্রামের খলিলুর রহমান জানান, আগে ধানের গোলা ছিলো গ্রামে যাদের জমি বেশি ছিলো তাদের। কিন্তু এখন যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ায় জমিও ভাগ হয়ে গেছে। যার ফলে গোলায় রাখার মতো ফসল আর হচ্ছে না। আর যাদের হচ্ছে তারা বিক্রি করে দেয় অথবা চালের মিলে রাখে। তিনি আরো জানান, এখন গোলা তেমন একটা দেখা যায় না। আর যাদের বাড়িতে গোলা আছে তারা এর ব্যবহার তেমন একটা করে না।

pic-3

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার সাল্যে মাছখোলা গ্রামের ডা. আহাতউল্লাহ সরদার জানান, ধানের গোলা থাকা মানে আগের সময় খুব বড় একটা ব্যাপার ছিলো। এলাকার গেরস্তদের ছিলো ধানের গোলা। কিন্তু আজ তা খুবই কম দেখা যায়। তিনি বলেন, “আমাদের বাড়িতে একাধিক গোলা ছিলো, কিন্তু এখন শুধু একটা গোলা আছে শুধু পারিবারিক ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য।” তিনি আরাও বলেন, “এখন আমাদের ফসলি জমিতে মাছের ঘের তাই ধান এখন খুব কম করা হয়, ফলে গোলার প্রয়োজন পড়ে না।

সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক শেখ আওসাফুর রহমান বলেন, “ধানের গোলা আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির একটি নিদর্শন। কিন্তু গোলা আজ বিলুপ্তির পথে। মানুষ আগে গোলা থেকে ধান নিয়ে ঢেঁকিতে চাল করতো। আর এখন ধান অটোমিলের গুদামে রেখে চাল প্রস্তুত করে। যার ফলে গোলার ব্যবহারটা আর হচ্ছে না।” তিনি আরও বলেন, “আবার আগে গোলা দেখে বাড়িতে চোর বা ডাকাত পড়তো ফলে মানুষ গোলার ব্যবহার না করে পাকা গুদাম করে ধান বা অন্য ফসল রাখা শুরু করে। ফলে গোলার ব্যবহার কমতে থাকে। তবে গোলা আমদের বাঙালি ঐতিহ্য, তাই এটাকে টিকিয়ে রাখা দরকার।”

happy wheels 2