একটি সম্মলিত উদ্যোগ বদলে দিয়েছে হাজার মানুষের পথচলা

নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা

সকাল হলেই এক ধরনে আতঙ্কে কেঁপে উঠে সারা শরীর এই ভেবে যে, চার বছরের মেয়েকে নিয়ে নদীর ওপারের স্কুলে যেতে হবে।  প্রতি দিনের মত প্রস্তুত হয়ে নদীর উপর বাঁশের সাঁকো দিয়ে মাঝামাঝি স্থানে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় রূপা বেগম, একি সাঁকো! নাকি মৃত্যু ফাঁদ?

%e0%a7%a7%e0%a7%a9
পঁচা বাঁশ ভেঙে মাঝামাঝি স্থানে ফাঁকা হয়ে গেছে, পা ফেলতেই দোলে উঠে সারা শরীর। না পারছে পেছনে যেতে না পারছে সামনে এগোতে! চোখে যেন সরষে ফুল দেখছে!, এ অবস্থায় ছুটে আসে দ’ুজন তরুণ (বারেক ও জুলহাস), বাড়িয়ে দেয় মততা ভরা তাদের হাত। তাদের সহায়তায় স্কুল পড়–য়া শিশুটিকে নিয়ে কোন রকমে সেদিন ধলাই নদী পার হয় রূপা বেগম। এমনি করে বছরের পর বছর নেত্রকোনা জেলার ধলাই নদীর পাড়ঁেঘষা মইনপুর গ্রামে শত শত মানুষ পার হচ্ছে ঝুঁকি নিয়ে এ বাঁশের তৈরি সাঁকো দিয়ে। সম্প্রতি মইনপুর গ্রামের তরুণ-যুবসহ সকলে মিলে সাঁকোটি পুণঃনির্মাণ করে। যার ফলে হাজার হাজার মানুষ নিরাপদে যাতায়াত করতে পারছেন। যদিও একটি ব্রিজ নির্মাণই হলো এলাকার মানুষের প্রাণের দাবি।

সাঁকোর ওপারে রেললাইন, এরপর নেত্রকোনা সরকারি কলেজ, দু’টি মাদ্রাসা, দু’টি কিন্ডার গার্টেন, দু’টি হাইস্কুল। মইনপুর গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষার্থী এসব স্কুলে পড়াশুনা করে। কলেজের মেসে যারা সিট না পায়, তারা কম খরচে মইনপুর গ্রামে বাসা ভাড়া নিয়ে মেস করে থেকে পড়াশুনা করে। গ্রামে কোন বাজার নেই, নদী পার হয়ে রেল ক্রসিং বাজার। গ্রামের লোক জনের দৈনন্দিন কেনা বেচা চলে এই বাজারেই। পার্শ্ববতী গ্রাম পুকুরিয়ার অনেক ছেলে-মেয়ে এই পথ ধরে জেলা সদরে স্কুল কলেজে যাতায়াত করে।%e0%a7%a7%e0%a7%aa প্রায় এক কিলোমিটারের মধ্যে নদী পারাপারের কোন ব্যবস্থা না থাকায় এবং জেলা সদরে শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসাসহ সকল কাজে প্রতিদিন নবীন, প্রবীণ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, চাকুরীজীবী সকল শ্রেণীর লোকের পথ চলা শুরু হয় সেই কাক ডাকা ভোর থেকে। হাজারও ভয় আতঙ্করের পরেও সকলে এই সাঁকো দিয়ে যাতায়াত করে গভীর রাত অবধি। মাঝে মাঝে দুর্ঘটনাও ঘটে।

সম্প্রতি এলাকার মানুষের এই কষ্ট ও আতঙ্ক লাঘবে এলাকার কিছু সবুজমনা মানুষ এগিয়ে আসে। নিজেরা ছোট ছোট বাঁশ সংগ্রহ করে, বড় বড় ভাঙা স্থানে জোড়াতালি দিয়ে সাময়িকভাবে চলার পথ সুগম করে দেয়। তারপরও সব সময় আতঙ্কে থাকে কখন আবার কোন বাচ্চা বা প্রবীণ ব্যক্তি বা গর্ভবতী মা নদী পারাপার হতে গিয়ে পা পিছলে না পড়ে যায়। সবুজমনা ঐ উদ্যোগী যুবকদের বাড়ি সাঁকো ঘাটের পাশে থাকায় তারা নিয়মিত আড্ডার স্থান হিসেবে বেঁছে নিয়েছে সাঁকোর পাশের চায়ের দোকান। কারো কোন ধরনেও সাহায্যের প্রয়োজন হলেই তারা ছুটে যায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে।

%e0%a7%a7%e0%a7%a8
কিন্তু এভাবে আর কত দিন! তাই তারা যোগাযোগ করে স্থানীয় চেয়ারম্যান এর সাথে। স্থানীয় চেয়ারম্যান তাদের আশ্বাস দিয়েছেন নদীর উপর পাকা ব্রিজ তৈরি করে দেয়ার। স্বপ্নের ব্রিজ এখনও স্বপ্নই রয়ে গেছে। তাই সবুজমনা যুব দলটি জরুরি ভিত্তিতে সকলে মিলে এলাকাবাসীদের সাথে আলোচনায় বসার উদ্যোগ নেয়। এলাকার সকল প্রবীণ ও সকল শ্রেণীর লোকদের সাথে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানে নিজেরাই সাঁকোটি পুনঃনির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। যুবদের এই উদ্যোগে সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত করে এলাকার নারীরা। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রামে যাদের বাড়িতে বাঁশ আছে তারা বাঁশ দিবে এবং যাদের বাড়িতে বাঁশ নাই তারা শ্রম দিয়ে বা প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহে সহায়তা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজে লেগে যায় এলাকার যুব, কিশোর, প্রবীণ, চাকুরীজীবীসহ সকল শ্রেণীর মানুষ। প্রায় অর্ধশতাধিক লোক সাঁেকা পুনঃনিমার্ণে দিন রাত পরিশ্রম করে দুই দিনে সাঁকোটি নতুন করে তৈরি করে চলাচলের উপযোগী করে গড়ে তোলে। আর এরই সাথে মুত্যৃ ফাঁদের আতঙ্ক থেকে মুক্তি পায় এলাকার সকল মানুষ। তবে এই উদ্যোগটিও স্থায়ী নয়।

মইনপুর গ্রামবাসীদেরকে এই কষ্ট থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তি দিতে প্রয়োজন প্রশাসনের জরুরি পদক্ষেপ। খুব শীঘ্রই এলাকাবাসীর স্বপ্নের ধলাই নদীর উপর পাকা ব্রীজ তৈরি হবে যেখান দিয়ে নির্ভয়ে শিশুরা মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাবে বলে তারা আশা করছেন। কিন্তু নবীন ও প্রবীণদের উদ্যোগে এলাকার হাজার মানুষে চলার একমাত্র সাঁকোটি যারা সাময়িকভাবে তৈরি করে চলাচলের উপযোগী করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। এভাবে সকল এলাকার ছোট ছোট সমস্যা সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সমাধান করে এলাকার উন্নয়নে আমরাও কি পারি না অবদান রাখতে?

happy wheels 2