কালের স্বাক্ষী রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী

সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল

বিলুপ্তির পথে যে জমিদার বাড়ী (1)অবহেলা আর সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্ত হতে চলেছে প্রাচীন রাজধানী খ্যাত রাজা প্রতাপাদিত্যের জমিদার বাড়ি। সুন্দরবনের কোলঘেঁষে দেশের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় এক সময়ের প্রভাবশালী রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল। পঞ্চদশ শতকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজধানীর রাজদরবার ও নানা স্থাপনা আজ কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দক্ষিণের এই জনপদের প্রাচীন সব ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। তা নাহলে কালের গর্ভে বিলীন হবে রাজার রাজ্যের সকল ঐতিহাসিক নিদর্শন। ইতিহাসের সাথে আগামী প্রজন্মের জন্য এখন প্রতীয়মান সকল স্থাপনাকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

সেসময় সমৃদ্ধশীল ছিল রাজার এই সুবিশাল জনপদ। রাজার সুনাম ও সুখ্যাতি ছিল রাজ্যময়। শোনা যেত রাজসৈন্যদের ঢাল তলোয়ারের শব্দ, আস্তাবলের ঘোড়ার ডাক। রাজদরবার ছিল জমজমাট, সন্ধ্যায় নৃত্যের তালে মোহিত হত রাজদরবার। রাজাহীন রাজ্যের সকল ঐতিহাসিক স্থাপনা আজ ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এখনও কিছু কিছু স্থাপনা কালের স্বাক্ষী হয়ে অবহেলায় দাঁড়িয়ে আছে।
বিলুপ্তির পথে যে জমিদার বাড়ী (2)
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক শতীস চন্দ্র মিত্রের যশোহর খুলনার ইতিহাসে উল্লেখ আছে, নবাব সোলায়মানের পুত্র নবাব দাঊদ শাহের আমলে যশোহর রাজ্যের রাজধানী প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ষোল শতকে মোঘল স¤্রাট আকবরের সাথে নবাব দাঊদ শাহের বিরোধ তৈরি হলে ‘রাজমহল’ নামক স্থানে এক তুমুল যুদ্ধ হয়। দীর্ঘ যুদ্ধে দাঊদ শাহের পরাজয় ঘটে। নিশ্চিত পরাজয় জেনে এসময় দাঊদ শাহ তাঁর বিশাল ধন সম্পদ মন্ত্রী বিক্রমাদিত্য এর পুত্র অন্য অঞ্চলের রাজা প্রতাপাদিত্যের নিকট পাঠিয়ে দেন। এ বিপুল ধন সম্পদ পেয়ে রাজা প্রতাপাদিত্য চলে আসেন সুন্দরবনের পাদদেশে। নবাব দাঊদ শাহের পাঠানো প্রচুর ধন সম্পদ চুরি করে ঈশ্বরীপুরে এক বিলাশবহুল রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। জনশ্রুতি আছে, এক স্থানের যশ (সম্পদ) হরণ (চুরি) করে অন্য স্থানে রাজ্য গড়ার কাহিনী লোকমুখে ফিরতে ফিরতে যশোহর বা যশোর নামটি তৈরি হয়। ১৫৯৯ সালে স্বাধীন রাজ্য ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথে রাজা প্রতাপাদিত্য রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সাথে এখানে গড়ে তোলেন নানা ধরনের বহু ইমারত ও দূর্গ। বহিঃশত্রু থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি মুকুন্দপুর থেকে কালিগঞ্জ হয়ে আশাশুনি পর্যন্ত দীর্ঘ গড় খনন করেন। লোকমুখে কথিত আছে, নতুনদের চেনানোর জন্য বলা হত সামনে গড়, এরপর থেকেই তৈরি হয়েছে শ্যামনগরের নাম।

রাজা প্রতাপাদিত্য রাজধানী প্রতিষ্ঠার পরেই সেখানে নানা ধরনের স্থাপনা ও রাজপ্রসাদ নির্মাণ করলেন। শ্যামনগরের সদর উপজেলার সন্নিকটে নকপিুর গ্রামে ভঙ্গুরাবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে রাজার তিনতলা বিশিষ্ট সুবিশাল রাজপ্রাসাদ। প্রশস্ত শান বাঁধানো সুবিশাল পুকুর ঘাট, বৃহৎ গেটসহ নানা স্থাপনা। রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজমহল থেকে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট টেঙ্গা মসজিদ। যা বর্তমানে বংশীপুর শাহী মসজিদ নামে বেশি পরিচিত। রাজ কর্মচারী ও মুসলিম সৈন্য সামন্তবর্গদের জন্য এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। এর অল্প একটু দুরেই রয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের পবিত্র তীর্থভুমি হিসেবে খ্যাত কালিমন্দির। যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরটি প্রাচীন আমলের হলেও এটি সংস্কারের মাধ্যমে নতুন প্রাণ ফিরিয়ে আনেন রাজা প্রজাপাদিত্য।
বিলুপ্তির পথে যে জমিদার বাড়ী (3)
কালিমন্দির সংলগ্ন একটি বিলুপ্তপ্রায় ভাঙাচোরা দালান যেটি হাবশিখানা হিসেবে পরিচিত ছিল। জনশ্রুতি আছে, এখানে রাজ্যের চোর ও দস্যুদের সাজা দিত। আবার অনেকে মনে করেন এটা ছিল রাজমহলের গোসলখানা। ছিল দৃষ্টিনন্দন চিলে কোঠা। পরবর্তীতে রাজা প্রতাপাদিত্য ধুমঘাট এর চরার চকে রাজধানী স্থাপন করে রাজাপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। এখানের প্রাচীন ঐতিহ্যের রাজধানীর নিদর্শন বলতে আছে শুধু কাছারী বাড়ির সেই বিখ্যাত সুবিশাল পুকুর ও পুকুরের পাড়ে বাঁধানো সুপ্রসস্ত ১৩ ধাপ বিশিষ্ট পাকাঘাট (আংশিক বিনষ্ট হয়ে পড়ে আছে)। প্রায় ৩ বিঘার মত সামন্তরিক আয়তনের পুকুরটির অর্ধেক অংশ স্থানীয় মানুষেরা দখল করে নিয়েছে।

সুনসান নিরাবতায় কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সকল স্থাপনা অযতœ আর অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। রাজা প্রতাপাদিত্যের ঐতিহাসিক সব নিদর্শনকে প্রতœতত্ব বিভাগের আওতায় এনে সংরক্ষণ করা জরুরি। তাহলে নতুন প্রজন্মের জন্য টিকে থাকবে প্রভাবশালী রাজা প্রতাপাদিত্যের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

happy wheels 2

Comments