বিপ্র-বেতিলা : সবুজ জ্বালানিতে আলোকিত সোলার গ্রাম

মানিকগঞ্জ থেকে নজরুল ইসলাম

অনিশ্চয়তাই যাদের নিত্য সঙ্গী তারা হলেন-যে কোন এলাকার চরবাসী। জাতীয় গ্রীড থেকে বিদ্যুৎ এই এলাকার মানুষের কাছে এখনো দূরাশা। কেরোসিনের (কুপি) বা হারিকেনই একসময় রাত্রিকালিন আলোর প্রধান উৎস ছিল। শিক্ষার্থীদের রাতের পড়ালেখাও চলত কেরোসিনের কুপি বাতিতেই এবং কেরোসিনের ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগে ভাগেই শেষ করতে হত পড়ালেখা। এরকম একটি গ্রাম হচ্ছে বিপ্র-বেতিলা। এই গ্রামের আঁধার দূর করতে দিন দিন জনপ্রিয় এবং বিকল্প হয়ে উঠছে সৌরলন্ঠন বা সৌরবিদ্যুৎ। ফলে বিদ্যুৎ সুবিধাবঞ্চিত চরের শিক্ষার্থীদের বাড়ছে রাত্রি কালিন পড়ালেখার ব্যাপ্তি। সাথে সাথে পরিবারের বাবা মায়ের বাড়ছে কৃষিতে কাজের ব্যাপ্তি এবং সামাজিক নিরাপত্তা।

মানিকগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার বিপ্র-বেতিলা গ্রামটি বেতিলা-মিতরা ইউনিয়নের নদীবেষ্টিত একটি দ্বীপ সাদৃশ্য গ্রাম। এই গ্রামের তিন দিকে আছে প্রাচীন ধলেশ্বরী নদীর শাখানদী কালিগঙ্গা। সদর উপজেলা এবং জেলা শহরের খুবই নিকটবর্তী হলেও যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে গ্রামটি স্বাভাবিকভাবেই বেশ দূর্গম। গ্রামের চারদিকেই কালিগঙ্গা নদী দ্বারা আচ্ছাদিত। কোন প্রাকৃতিক বন না থাকলেও ঝোঁপ-ঝাড় আছে। পাশপাশি কিছু সামাজিক বনায়ন লক্ষ্য করা যায়।
সম্পূর্ণ গ্রামটি অফগ্রিড বিধায় অধিকাংশ পরিবার সোলার ব্যবহার করে আলোর জন্য এবং রান্নার ক্ষেত্রে বায়োমাস ব্যবহার করে। অর্থাৎ লাকরি, বাঁশের পাতা, খঁড়কুটো, গরুর গোবর  দিয়ে প্রচলিত চুলা এবং প্রচলিত পদ্ধতিতেই তারা রান্না সম্পন্ন করেন।

Energy
শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে সৌরবিদ্যুতের প্রভাব নিয়ে জেলার সুবিধাবঞ্চিত চরাঞ্চল দৌলতপুরের বাচামারা, হরিরামপুরে পাটগ্রাম চর, ঘিওর উপজেলার বাইলজুরি গ্রাম ও সদর উপজেলার বিপ্র-বেতিলা গ্রামে একটি গবেষণা পরিচালনা করে বারসিক। ঐ সকল গ্রামে সৌর বিদ্যুৎ সরবারহ করেছে- গ্রামীণ শক্তি, টি.এম.এস.এস., আভাসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণদানকারি প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও আগ্রহী অনেক পরিবার ব্যক্তি উদ্যোগেও সরাসরি দোকান হতে ক্রয় করেছে এই সেবা।

গবেষণার অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ৪টি চরের ১৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা করা হয়। এর মধ্যে হতে একটি বিপ্র-বেতিলা চর এর চারপাশে প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ২টি ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ২টি। গবেষণার জন্য প্রাথমিকভাবে বেছে নেওয়া হয় ৪র্থ হতে ৮ম শ্রেণীর ২৭২ জন শিক্ষার্থীকে। প্রতিটি শ্রেণীতে নূন্যতম বিদ্যুৎ নেই কিন্তু এখনো কেরোসিনের আলোতে পড়ালেখা করে এমন পরিবারের মধ্যে ৩টি, সোলার আছে ৩টি পরিবার ও গ্রীড বিদ্যুৎ আছে ৩টি পরিবারকে বাধ্যতামূলকভাবে অর্ন্তভূক্ত রাখা হয়। তিনটি ভাগে বিভক্ত করে নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাচাই করা হয় সৌরশক্তি ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান, শারিরিক ও মানসিক অবস্থায় কোন ধরনের পরিবর্তন এনছে কি? পাশাপাশি এটি পরিবারে জ্বালানি সাশ্রয়ে কতটুক ভূমিকা রেখেছে?

গবেষণায় দেখা যায় যে, সৌর বিদ্যুৎ এর ফলে বাড়িতে শিক্ষার্থীদের রাত্রিকালিন পড়াশোনার সময়কাল বেড়েছে। পরীক্ষার আগের রাতে পড়াশোনার সময়কাল বেড়েছে। এই বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের পর প্রথমদিকে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হারও বেড়ে যায়। যদিও পরবর্তীতে সেটি স্থিতিশীল হয়নি। গত এক বছর ধরে নিয়মিত এসব তথ্য পর্যবেক্ষণ রাখা হয়। তাতে দেখা যায়, সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীদের রাতে পড়াশোনার সময় বেড়েছে ২০-২৫ মিনিট। রাতের পড়ালেখায় জোর দেওয়ায় দিনের বেলায় পড়ালেখায় সময় কমেছে ৫-৮ মিনিট। সব মিলিয়ে এ আট মাসে বাড়িতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সময় বেড়েছে মোট ৪৫-৭৫ ঘণ্টা।

energy-1
ছাত্র তৌহিদুল ইসলাম বলেন, “বাড়িতে বিদ্যুৎ না থাকায় ৪ বছর আগেও কেরোসিনের বাতিতেই চলতো তার পড়ালেখা। কিন্তু কেরোসিন সাশ্রয়ে বেশি রাত পর্যন্ত লেখাপড়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ২০১৩ সালে বাড়িতে সৌর বিদ্যুৎ আসার পর রাত্রিকালিন পড়ালেখার ব্যপ্তি বেড়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে পরীক্ষার ফলাফলে। এখন সে জেলার সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান (সম্মান) ২য় বর্ষে অধ্যয়নরত সেরা শিক্ষার্থীদের অন্যতম একজন।

শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকার্যক্রমে সৌর বিদ্যুৎ এর ইতিবাচক প্রভাবের কথা স্বীকার করেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরার। বেতিলা ১নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, “গত কয়েক বছরের তুলনায় বর্তমানে তার বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান অনেক ভালো।” তিনি আরো বলেন, “সৌর বিদ্যুৎ এর কারণেই এমন পরিবর্তন এসেছে। এখন অনেক শিক্ষার্থীর বাড়িতে লাইট (বিদ্যুৎ) না থাকলেও সোলার এর মাধ্যমে সন্তানদের পড়ালেখার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন অভিভাবকেরা। এর প্রভাব পড়েছে পরিবারের সকল কাজে।”

পাশাপাশি, যেসমস্ত পরিবার সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার শুরু করেছে তাদের মধ্যে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এলাকার মানুষ প্রচলিত কেরোসিন, হারিকেনের ব্যবহারের পরিবর্তে সৌরশক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। এতে কার্বন নির্গমন কারি কেরোসিন কেনা বাবদ তাদের ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ সাশ্রয় হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে এসব পরিবারের জ্বালানি ব্যয় কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখছে।

Energy-2
নিরাপত্তা জনিত সমস্যা কিছুটা হ্রাস পেয়েছ। সোলারের বাতি সারারাত জ্বলে ফলে চুরি করা সহজ হয় না বলে মনে করেন কৃষক ফজলুল হক। “এই গ্রামে যখন কোন সোলার বাতি জ্বালত না তখন প্রচুর ডাকাতি হয়েছে। বিশেষ করে গরু চুরি হয়েছে। বর্তমানে সোলার আলোর কারণে এখন পর্যন্ত কোন চুরি ডাকাতি হয়নি।” বললেন কৃষক নেতা কফিল উদ্দিন(৭২)। উল্লেখ্য যে, ইতেমধ্যে গবেষণা পরবর্তীতে সরকারি, বেসরকারি ও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে গ্রামটিকে সবুজায়িত সোলার গ্রাম ঘোষণা করা হয়েছে।

বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থার কারণে বিপ্র-বেতিলার মতো অসংখ্য চরে জাতীয় গ্রিডে অর্ন্তভূক্ত করা সম্ভব না। প্রধানত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং দ্বিতীয়ত এগুলোর স্থায়িত্বের কারণে। কিন্তু সৌর শক্তির কার্যকর ব্যবহার এই সমস্ত এলাকার জন-জীবনে বয়ে আনতে পারে আলো, শিক্ষা, সমাজিক নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি সমৃদ্ধি। কিন্তু, এই সমস্ত গ্রামগুলোকে সৌর শক্তির আওতায় আনার জন্য এই ব্যস্থার সাথে সম্পর্কিত সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাজারো বিপ্র-বেতিলা জ্বলে উঠবে সূর্যের শক্তিতে। হবে আলোকিত হাজারো বর্গ কিলোমিটার সোলার এর আলোয়।

happy wheels 2

Comments