বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি সাশ্রয়ী রবিশস্যের পরীক্ষামূলক মিশ্রচাষ

তানোর, রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার

সেচ পানির মূল্যবৃদ্ধি, প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত সেচপানি সরবরাহ ও বৈদ্যুতিক সমস্যার কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার কৃষকরা বিগত রবি মৌসুমে সেচনির্ভর বোরো ধান চাষের পরিবর্তে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করেছেন ডাল, তেল ও মসলা জাতীয় নানান শস্য-ফসলের।
17321681_1353891168005922_2109804707_n
প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, ভৌগলিক অবস্থান ও ভূগর্ভস্থ পানির ওপর সেচকাজ ও প্রাত্যহিক নির্ভরতার ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি সমস্যা দিন দিন প্রকটতর হচ্ছে। বিদ্যুৎ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় রাজশাহী জেলার তানোর, গোদাগাড়ি উপজেলা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, গোমস্তাপুর, রহনপুর ও নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর, পোরশা ও সাপাহার উপজেলার বসতবাড়ি ও কৃষিজমিতে পানি সেচপ্রদান বর্তমানে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মাটির গঠনগত বৈশিষ্ট্য ও ভূগর্ভস্থ পানির রিচার্জ কম হওয়ার কারণে এ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নিচে নামছে। প্রাকৃতিক এই বিরূপতায় এলাকার কৃষকরা নানাভাবে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।

বর্তমান এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এ অঞ্চলের কৃষকরা বোরো ধান চাষের পরিবর্তে পানি সাশ্রয়ী ডাল তেল ও মসলা জাতীয় ফসলের চাষাবাদে আগ্রহী হন। উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক’র সহায়তায় রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি  উপজেলার বরশীপাড়া গ্রামের  বরশীপাড়া কৃষক ঐক্যের কৃষকরা ৯ শতাংশ জমিতে ৯ ধরনের রবিশস্য যেমন যব, জাউন বাকলাকালাই, কুসুমফুল, কাউন, রাঁধুনি,  ধনিয়া, শুলটিকালাই, শলুক নিয়ে মিশ্রচাষ করেন। 17342128_1353890624672643_1678868122_oএকইভাবে রাজশাহীর, পবা উপজেলার তেতুলিয়া ডাঙ্গা গ্রাম উন্নয়ন কমিটির  কৃষকরা ৮ শতাংশ জমিতে চিনা, গুজিতিল, কাউন, জাউন, আমন তিল, মসুর, খেসারি, বাকলা কালাই, যব, ধনিয়া, তিসিসহ মোট ১১ ধরনের রবিশস্যের মিশ্র চাষ করেন। জেলার পবা উপজেলার ওমরপাড়া গ্রামের বড়গাছি কৃষক ঐক্যের কৃষকরাও নিজেরা আগ্রহী হয়ে ৭ শতাংশ জমিতে গুজিতিল, কাউন, জাউন, কালোজিরা, আমনতিল, তিসি, কাউন, ধনিয়া, মসুর, যব, বাকলা কালাই, খেসারী, শলুকসহ ১৩ ধরনের রবিশস্যের মিশ্রচাষ করেন। এমনিভাবে রবি মৌসুমে বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি, তানোর ও পবা উপজেলা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলার সর্বমোট মোট ১২টি গ্রামের ৪৭জন কৃষক ১৮.৫ বিঘা জমিতে মসলা, ডাল ও তেল জাতীয় ফসলে পরীক্ষামূলক চাষ করেছেন।

পরীক্ষণ ফলাফল সহভাগিতার জন্য ইতোমধ্যে গোদাগাড়ি জেলার বরশীপাড়া গ্রামে মাঠ দিবসের আয়োজন করা হয়। অন্যদিকে বিগত ১৩ মার্চ, ২০১৭ তারিখে রাজশাহীর পবা উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নের ওমর পাড়ায় আয়োজিত মাঠ দিবসে হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বড়গাছি কৃষক ঐক্যের সভাপ্রধান ও চারবার কৃষিতে জাতীয় পদক প্রাপ্ত বর্ষীয়ান কৃষক মো. আব্দুর রহিম।IMG_1480 তিনি বলেন, “১৫ থেকে ২০ আগেও এই ফসলগুলো  এলাকায় চাষ হতো। এগুলো চাষে খরচও কম, বিক্রয় দামও ভালো পাওয়া যায়। বর্তমান একমুখী শস্য-ফসল চাষের পরিবর্তে এই জাতগুলো অনেক ভূমিকা পালন করবে।” পরীক্ষণ প্লট পরিচালনাকারী  কৃষক মো. রায়হান জুয়েল বলেন, “রবিশস্যগুলো স্থানীয় এলাকায় কেমন জন্মে তা দেখার জন্য পরীক্ষা করা হয়।  ফসলগুলোতে বর্তমান সময় পর্যন্ত কোন ধরনের রোগ-পোকার আক্রমণ হয়নি। তাই  কোন ধরনের রাসায়নিক সার এবং বিষ দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। শীতের সময় এবার মাঝে মাঝে প্রচুর শীত ও কুয়াশাতেও ফসলগুলো নষ্ট হয়নি।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের পরীক্ষাধীন ১৩টি জাতই অনেক সুন্দর হয়েছে এবং আমাদের আশানুরূপ ফলন হবে।” প্রবীণ কৃষাণি মোসা. শাহার খাতুন বলেন, “আমরা নারীরা একসময় এই ফসলগুলো সংরক্ষণ করতাম, সে সময় প্রতিবছর আবাদ করা হতো। তখন মাটির নিচ থেকে  পানি তোলার এত যন্ত্র ছিলো না, সেচের ব্যবস্থাও ছিলো না, তাই এই খরা সহনশীল ও পানি সাশ্রয়ী জাতগুলোর চাষ হতো। কিন্তু দিনে দিনে জাতগুলো হারিয়ে যাবার ফলে তা আর চাষ করতে পারি না।”

বরেন্দ্র এলাকার কৃষকরা সেচ সমস্যা সমাধানে নিজেরাই আগ্রহী হয়ে পানি সাশ্রয়ী রবিশস্য চাষের মাধ্যমে উত্তরণের পথ খুঁজছেন। আসুন কৃষকদের এই প্রচেষ্টাকে সহযোগিতা করে আরো বেগমান করি।

happy wheels 2

Comments