মা দিবসের কোন বিশেষণই জানে না মানিকগঞ্জের হাজারো মায়েরা

আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ ॥

আজ বিশ্ব মা দিবস। সারাবিশ্বে বেশ ঘটা করেই দিনটি মাকে উৎসর্গ করেছে শত কোটি মানুষ। কিন্তু মানিকগঞ্জের হাজারো মা জানেন না ‘মা দিবস’ বলে কোনো দিবস আছে! এ দিবসের বিশেষণ সম্পর্কে না জানলেও সন্তানের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র ভালোবাসার কমতি নেই। বড় হয়ে সন্তানরা কর্মব্যস্ততার মাঝে মাকে ভুলে থাকলেও মা ভুলেন না কখনো। এমনি কয়েকজন মায়ের জীবন চিত্র তুলে ধরা হলো, যে মায়েদের সন্তান থাকতেও মা ডাক শোনা হয়না। সামর্থবান সন্তান থাকতেও যে মায়েদের জীবন চলে কঠোর কায়িকশ্রম আর অন্যের দয়ায়।

Exif_JPEG_420

জেলার দৌলতপুরের চর এলাকার এলাকার প্রবীণ লালতারা বেওয়ার বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে। জেলা শহরের এক বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন দীর্ঘ ২ যুগেরও বেশি সময় যাবত। কোলে শিশু ছেলে আর ৫ বছর বয়সী এক মেয়ে রেখে তার স্বামী নিরুদ্দেশ হয় ৩০/৩৫ বছর আগে। জীবনের তাগিদে শিশু সন্তানকে কোলে নিয়েই করতে থাকেন বিভিন্ন কায়িক শ্রম। অবুঝ শিশুদের মুখ পানে চেয়ে তার জীবনের স্বর্ণালী সময়ে আরম্ভ করা সেই হাড়ভাঙা খাটুনি, তা যেন এ জীবনে আর ফুরায় না। অন্যের বাড়িতে ঝি-এর কাজ করেই তিলতিল করে জমানো টাকায় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আদরের নাড়ী ছেঁড়া ধন একমাত্র ছেলে একটি গার্মেন্টেসে কাজ করে। বিয়ে করে তারা সন্তানসহ ঢাকায় থাকে। খোঁজ নেয় না মায়ের। বয়সের ভারে লালতারা বেওয়ার শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা অসুখ বিসুখ। এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না। দু’বেলা দুমুঠো ভাত খাচ্ছেন তিনি ঠিকই কিন্তু তা অন্যের দয়ায়। জানালেন, “বছর তিনেক আগে ঈদের দিন আমার ছেলে আসছিল; তিনশো ট্যাকা দিয়ে গেছে। মেয়ের বিয়া অইছে ম্যালা বড় বাড়িতে; আমার পরিচয় দেয় না, ওগো খুব লজ্জা লাগে। সারাডা জীবন রক্ত পানি কইরা ওগোরে বড় করলাম যাতে শেষ বয়সে ওরা আমারে দ্যাহে  (দেখে), তা আমার কপালে সইলো না। এমন কপাল আল্লায় যেন কাউরে না দ্যায়। তবুও দোয়া করি আল্লায় যেন ওগোরে সুখে রাখে।” কথা বলার সময় দু’চোখের কোণে পানি টলমল করছিল। বারবার কাপড়ের আঁচল দিয়ে পানি মোছার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে কেঁদে ওঠেন হাউমাউ করে অস্ফুট স্বরে শুধু বললেন, “ওগো দেখবার খুউব মন চায়–কত দিন দেখিনা ওগোরে। কতদিন মা যাক শুনি না।”

শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে বৃদ্ধ বয়সে এসেও ভিক্ষা করতে হচ্ছে এক অসহায় মা হাজেরা বেগমকে। ঘিওরের তরা এলাকায় খুড়িয়ে খুড়িয়ে ভিক্ষা করছেন তিনি। বয়সের ভারে বৈশাখের তপ্ত দুপুরে ঠিকমতো পথও চলতে পারছিলেন না। ছেলে রায়হান বিয়ে শাদী করে শশুর বাড়িতে থাকে। একটিবারও খোঁজ নেয় না গর্ভধারিণী এই মায়ের। তবু সন্তানের প্রতি তার কোন আক্ষেপ নেই। মা দিবস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বেশ অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে উওর দেন, “সেইডা আবার কি বাপু, এই কতা তো আগে হুনি (শুনি) নাই।” এসব দিবসের চাইতে জীবন বাঁচানোর তাগিদই তাদের কাছে এখন মুখ্য। তবুও তারা সবসময় দোয়া করে তার সন্তান যেন ভালো থাকে।
manikgonj (1)
বিষন্ন আকাশ পানে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটি। আকাশের বুকে জমা হওয়া মেঘের মতই একরাশ কাল মেঘ জমে আছে তার মনের পটে। গুমোট মেঘের দল যেকোন সময় কান্না হয়ে ঝড়ে পড়বে। আকাশের মেঘ কেটে সূর্য হাসলেও ছেলেটির মনে আনাগোনা করা গুমোট মেঘের দল কখনও সড়বে না, কারণ যে সূর্য দূর করবে অন্ধকার- সেই সূর্যকে হারিয়ে ফেলেছে ছেলেটি। সেই আলোক উৎস হারিয়ে গেছে ছেলেটির জীবন থেকে। গুমোট মেঘের অন্ধকার কেটে গিয়ে আলোয় হাসবে না কখনও তার মন। কারণ তার জীবনে সেই সূর্যটি নেই, ছেলেটির মা নেই এই পৃথিবীতে। হ্যাঁ, এই ছেলেটির মত হতভাগা আর কে বা আছে? ঘিওর এলাকার মজলিশ মল্লিকের স্ত্রী আলেয়া বেগম আজ থেকে ৪ বছর আগে নিহত হয় রানা প্লাজা ধ্বসে। তখন তার ঘরে ছিল দুই বছরের একমাত্র ছেলে। অস্ফুট স্বরের সেই মা..আ ডাকটি হারিয়ে গেছে চিরকালের জন্য। ছেলেটির বয়স এখন ৬। ভালোই কথা বলতে পারে ফুটফুটে মুখে। এখন সে বুঝতে শিখেছে, হাজারবার মা..মা বলে ডাকলেও কিন্তু একটিবারের জন্যও যে মা আর আসবে না! পরিবারের সব সদস্যরা হয়তো বেশ সুখেই রাখার প্রচেষ্টা করছে তবুও মায়ের অপূরণীয় অভাব তাড়িয়ে বেড়ায় শিশুতোষ মনটাকে। কোমল নয়নজোড়া এখনো খুঁজে বেড়ায় তার মাকে।

মা এমন একজন ব্যক্তি, এমন একটা প্রয়োজন, এমন একটা ভালোবাসা- যার কোন তুলনা নেই। মা এমনই একটা শব্দ যার এক ও একমাত্র প্রতিশব্দ- ভালোবাসা। তেমনি কান্না manikgonj (2)মিশ্রিত এসব মায়ের দুঃখগাঁথার বিপরীতে আছে কিছু সুখের পংক্তিমালা। সন্তানদের সুখের জন্য একজন মা যে কতটা কষ্ট করেন তার একটি উদাহরণ মানিকগঞ্জের আরুয়া ইউনিয়নের বাউলিকান্দা গ্রামে মর্জিনা বেগম। ১৮ বছর আগে দুই শিশু সন্তান রেখে মর্জিনা বেগমের স্বামী ঢাকায় কাজের খোঁজে গিয়ে আর ফিরেননি। পরে জানতে পারেন তিনি মারা গেছেন। এরপর থেকেই শুরু হয় তাঁর জীবনযুদ্ধ। সংসারের হাল ধরতে কখনো অন্যের বাড়িতে, কখনো আবার কাজ করেছেন ফসলের মাঠে। এখনো মর্জিনা বেগম কেয়ার বাংলাদেশের হয়ে ইউনিয়ন পরিষদের একজন তালিকাভুক্ত মাটি কাটা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু এই সংগ্রামী নারী তার ছেলেকে বানাচ্ছেন এমবিবিএস ডাক্তার। ছেলে রিপন বিশ্বাস ঢাকার একটি মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র। মেয়ে সুরমা আক্তার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। তাকেও আইনজীবী বানাতে মা চান মর্জিনা।

মর্জিনা বেগম জানান, অভাবের মধ্যে দুই ছেলে-মেয়ের লেখাপড়াকে আত্মীয়স্বজন আর প্রতিবেশিরা বাঁকা চোখে দেখতো। তাদের লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে। কিন্তু ছেলের একের পর এক ভালো রেজাল্টে সবাই খুশি হয়েছেন। এ পর্যন্ত আসার পেছনে এলাকাবাসীও অনেক আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। মুখে এক গাল তৃপ্তির হাসি হেসে তিনি জানান, “আজ আর আমার কোনো কষ্ট নেই। আমি সব কষ্টের কথা ভুলে গেছি। ছেলে আমার ডাক্তার হইছে, গরিব দুখীর সেবা করতে পারবে।” মেয়েকে উকিল বানাবেন, যেন সেও মানুষকে আইনি সেবা দিতে পারে। ছেলে রিপন বিশ্বাসও তার মায়ের এই কষ্টে অঝরে কাঁদে। তার স্বপ্নও একদিন তার মায়ের মুখে সে পরিতৃপ্তির হাসি ফুটাবেই। তার গর্ব সে একজন আদর্শ মায়ের গর্ভে জন্মেছিল।

Exif_JPEG_420

সারাজীবন সেবা করেও সন্তান মায়ের অবদান শোধযোগ্য নয়। যদিও মা কখনো সন্তানের কাছ থেকে প্রতিদানের আশা করেন না, তবুও মায়েদের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব অনেক। মায়ের এই অবদানকে তুলে ধরতেই প্রতিবছর পালিত হয় বিশ্ব মা দিবস। ১৯১২ সালে আনা জার্ভিস স্থাপন করেন মাদার’স ডে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোশিয়েশন (আন্তর্জাতিক মা দিবস সমিতি) এবং “মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার” আর “মা দিবস” শব্দের  বহুল প্রচার করেন। ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দিবসটিকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এরপর থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মা দিবসটি পালনের রেওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে।

সূর্য রোজ প্রভাতেই পূব দিকে আলোর কিরণ দিয়ে অন্ধকার দূর করে বলে আলাদা করে হয়তো আমরা সূর্যের কথা ভাবিনা। কিন্তু কোন কারণে যদি সূর্যটা হারিয়ে যায়, হারিয়ে যাবে পুরো পৃথিবীই। আমাদের জীবন আকাশের সূর্যটিও এক সময় হারিয়ে যাবে, অন্ধকার মেঘে ঢেকে যাকে সবকিছু। কিন্তু যতক্ষণ এই সূর্যটি আছে, যতক্ষণ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আপন- মমতাময়ী “মা” আছে, ততক্ষণ তাঁকে আগলে রাখি পরম যতনে; যেমনটা তিনি আমাদের আগলে রাখেন আজীবন। ‘মা দিবসে’- এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

# ছবি: লেখক

happy wheels 2

Comments