প্রাণ, প্রকৃতি, আমাদের নতুন প্রজন্ম ও ভবিষ্যত

নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা

 

বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে মানুষ প্রতিনিয়ত নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। চারপাশে তাকানোর মতো ফুসরত কারো নেই, শিশুদেরও একই অবস্থা। চার বছর বয়স থেকেই শিশুদেরকে প্রতিদিন রুটিন মাফিক ঘুম থেকে উঠা এবং ঘুমাতে যেতে হয়। পিতামাতার ইচ্ছায় সন্তানদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নির্ধারিত হচ্ছে। সন্তানরা উচ্চ শিক্ষিত হয়ে সুন্দর ও বিলাসবহুল জীবনের প্রত্যাশায় চোখ কচলাতে কচলাতে ভারি বইয়ের ব্যাগ পিঠে নিয়ে স্কুলে যায়। পিতামাতার স্বপ্ন পূরণের জন্য শিশুরা প্রাণহীন যন্ত্রের ন্যায় জীবনযাপন শুরু করে। বেশ কয়েকবছর আগে পর্যন্ত এ ধরণের চিত্র চোখে পড়তো শহরাঞ্চলে, কিন্তু বর্তমানে গ্রামাঞ্চলেও এ চিত্র নিত্য দেখা যাচ্ছে। যেখানে শিশুদের খেলাধুলা ও হাসি-আনন্দে মেতে থাকার কথা সেখানে তারা রোবটের ন্যায় দিন যাপন করছে। ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাওয়া, স্কুল থেকে ফিরে কেচিং  এ, কোচিং থেকে প্রাইভেট পড়া নিয়েই দিন যায় শিশুদের। যে সামান্য সময়টুকু পায় তা মোবাইল গেম বা টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখে পার হয়। প্রাণ ও প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়ার সময় কোথায় তাদের? ফলে নতুন প্রজন্ম দিন দিন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে প্রাণ ও প্রকৃতি থেকে।

20170524_102637-W600
প্রকৃতি অনুরাগী নেত্রকোনার বাসিন্দা শিক্ষক সেলিনা আক্তার নতুন প্রজন্মের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “নেত্রকোনার একটি ছোট শহর যেখানে কয়েক বছর আগেও শত শত পাখির শব্দে মানুষের ঘুম ভাঙতো। প্রতিটি স্কুলে বুকুল, শিমুল, কাঠবাদাম গাছের ছায়ায় আমরা খেলাধুলা করতাম ও আড্ডা দিতাম প্রকৃতির নির্মল বাতাসে। পাশাপাশি স্কুলের চারপাশে ক্যাম্পাসের গাছ থেকে আম, জাম, পেয়ারা, বড়ই, তেঁতুল ইত্যাদি ফল খেয়ে স্কুল জীবন অতিবাহিত করেছি।” তিনি আরও বলেন, “রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতাম স্কুলের গাছে ওঠেছি, বন্ধুদের সাথে খেলা করছি। সেই স্কুলগুলো আজ নতুন করে সাজানো হচ্ছে, প্রাচীন বৃক্ষ কেটে ফেলে দিয়ে তৈরি হচ্ছে সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা। খেলার মাঠের আয়তন ছোট হয়ে গেছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার বা আড্ডা দেয়ার জন্য কোন মাঠ বা স্থান পর্যন্ত নেই।” তিনি বলেন, “প্রকৃতির নির্মল বাতাস থেকে শিশুরা বঞ্চিত, তারা বৈদ্যুতিক বাতাসে নিজেদের অভ্যস্ত করেছে। কিন্তু বৈদ্যুতিক বাল্ব বা বৈদ্যুতিক পাখা প্রকৃতির নির্মল বাতাস সেবন ও খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত একজন শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে কীইবা ভূমিকা রাখতে পারে, তা নিয়ে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনাকারীদের কোন ধরনের মাথাব্যাথা নেই। নতুন প্রজন্মের শিশুরা সৃজনশীল স্বপ্নও দেখেনা। স্বপ্ন দেখে তার দৈনন্দিন জীবনে ঘটে যাওয়া বাস্তবতা নিয়ে। স্বপ্ন দেখে মায়ের সাথে স্কুলে যাওয়ার জন্য রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে অটো বা রিক্সার অপেক্ষায় বিরক্তি মন নিয়ে এবং যান্ত্রিক শব্দ থেকে নিজেকে রক্ষায় কানে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চিত্র”।

20170524_102719-W600
অন্যদিকে নতুন প্রজন্ম বিশুদ্ধ ও নিরাপদ প্রাকৃতিক খাবার থেকেও বঞ্চিত। তারা যে খাবারগুলো খাচ্ছে সেগুলোর অধিকাংশই কৃত্রিমভাবে তৈরি। শিশুরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে বহুজাতিক কোম্পানীর উৎপাদিত কৃত্রিম মূখরোচক খাবারে। কোন কিছু খেতে বললে নতুন প্রজম্মের শিশুরা বার্গার, স্যান্ডউইচ, ভ্যাজিটেবল রোল, গ্রীল, চিকেন শর্মা, চিকেন ফ্রাই, স্যুপ, সফ্ট ড্রিংস, এনার্জি ড্রিংস ইত্যাদি খাবার খেতে চায়। স্কুলের সামনের খাবার বিক্রি সম্পর্কে শিক্ষক হাসনা আক্তার তাই বলেন, “একসময় স্কুলের সামনে বাদাম, চানাচুর, নারকেলি ও মালাই আইসক্রিম, মৌসুমী ফল যেমন বুবি/লটকন, জাম, জামরুল, খিড়া, তরমুজ, সবেদা ইত্যাদি দেশীয় খাবার ছাড়া কোম্পানির খাবার বিক্রি হতো না। আজকাল পিতা-মাতাগণ বাজার থেকে দামী ফল কিনে নিয়ে এসে বাচ্চাদের খাওয়ায়। যে ফলগুলোর অধিকাংশই বিষাক্ত ও প্রাণঘাতি কার্বাইড, ফরমালিন ও বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকর হরমন দিয়ে উৎপাদিত। পাকা চার দেয়ালের ভিতরে একজন শিশু শিক্ষার্থীকে দিনে প্রায় ৭ থেকে ৮ ঘন্টা লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। বাইরে থেকে খোলা ও ধুলাবালুযুক্ত ভেজাল খাবার খেয়ে শিশুরা প্রায়শই অসুস্থ্য হয়ে পড়ছে।”

সবুজ চিন্তার মানুষ আরেকজন শিক্ষক মো. নূরুজামান বলেন, “অভিভাবকরা নিজেদের সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তায় রাতের ঘুম হারাম করছে, কিন্তু তারা একবারও ভাবছেন না শিশুর সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য একটি চকচকে অট্টালিকার চেয়ে প্রাণ ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর সুন্দর পরিবেশ দরকার। অভিভাবকরা নিজেদের অজান্তেই তাদের নতুন প্রজন্মকে প্রাণ ও প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে বড় করছেন।” তিনি আরও বলেন, “যে গাছ কোন স্বার্থ ছাড়া একজন মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন দিচ্ছে, ফল দিচ্ছে, আশ্রয় দিচ্ছে, প্রাকৃতিক দূর্যোগের হাত থেকে ছোট ছোট প্রাণ ও পশু-পাখিকে রক্ষা করছে। শুধু মানুষের কল্যাণে অবিরাম অবদান রেখে চলেছে প্রকৃতির প্রত্যেকটি উপাদান, যেমন-গাছপালা, পশু-পাখি, বিভিন্ন জীবজন্তু ইত্যাদি। সেই প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি কোনরূপ আগ্রহ বা কৃতজ্ঞতা ছাড়া (তাদের অজান্তে) বেড়ে উঠছে এই সুন্দর পৃথিবী রক্ষার ভবিষ্যত দায়িত্বে থাকা আগামী প্রজন্ম।”

20170524_102837-W600
আগে আমরা ঘুম থেকে জেগে উঠতাম পাখির ডাকে, কিন্তু অজকালকার শিশুরা পাখির ডাকে নয়, ঘুম থেকে জাগে  অটো বা যানবাহনের কান ফাটানো কর্কষ শব্দে। ঘরের দেয়ালে বন্দি থাকে তাদের চিন্তা চেতনাগুলোও। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটে ও টেলিভিশনের ভিন দেশি ও পরসংস্কৃতির প্রতি আসক্ত নতুন প্রজন্মকে প্রাণ ও প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক রক্ষায় তাদের কতিপয় দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করার লক্ষ্যে বারসিক’র উদোগে প্রাণবৈচিত্র্য দিবসকে কেন্দ্র করে নেত্রকোনা অঞ্চলে সপ্তাহব্যাপী (২২-২৮ মে) বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচিগুলোর একটি ছিল এলাকার প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় নতুন প্রজম্মের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। বারসিক, নেত্রকোনা উচ্চ বিদ্যালয় ও দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উদ্যোগে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রায় ৮০০ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারী সকল শিক্ষার্থী ও শিক্ষকগণ হাত তুলে মুষ্টিবদ্ধ করে নেত্রকোনার প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষায় কাজ করার শপথ গ্রহণ করে।

প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান সম্পর্কে শিক্ষক রুহুল বারী বলেন, “বারসিক’র কাছে আমরা কৃতজ্ঞ এজন্য যে, তারা একটি ভিন্ন চিন্তায় শিক্ষার্থীদের যুক্ত করেছে। প্রাণবৈচিত্র্য (প্রাণ ও প্রকৃতি) দিবস সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা ছিলো না। কখনও ভাবিনি এসব রক্ষায় কিছু দায়ভার আমাদেরও রয়েছে। ভালো লাগছে এই ভেবে যে, একটু 20170524_113110-W600দেরিতে হলেও একটি সুন্দর ভাবনার সাথে নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছি। আমরা প্রতিবছর এ দিবসটি পালনের অঙ্গীকার করছি। সেই সাথে প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের রমজানের ছুটিতে নিজ নিজ বাড়িতে বৃক্ষ রোপণের জন্য উদ্বুদ্ধ করব”। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা পবিত্র রমজানের ছুটিতে নিজ নিজ বাড়িতে বৃক্ষ রোপণের শপথ গ্রহণ করে।

বর্তমান সময়টি প্রতিযোগিতার সময়, যারা প্রতিযোগিতায় জয়ী হবে তারাই পৃথিবীতে ভালোভাবে ও আরাম আয়েশে টিকে থাকবে। তবে এই প্রতিযোগিতা শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জন ও সম্পদ অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। ভালোভাবে জীবনযাপনের জন্য অবশ্যই সম্পদ বা বিত্তের প্রয়োজন, তবে তাই বলে প্রাণ ও প্রকৃতিকে ভূলে বা এড়িয়ে সম্পদ ও জ্ঞান অর্জনে নিবিষ্ট থাকলেই চলবে না। প্রাণ ও প্রকৃতিকে অক্ষুন্ন রেখে এবং এগুলোর ভারসাম্য বজায় রেখে আমাদের জ্ঞান ও সম্পদ অর্জন করতে হবে। মানুষের বিলাসী জীবনের জন্য প্রাণ ও প্রকৃতির কোনরূপ ক্ষতি যাতে না হয় সেদিকে সকলের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে, নতুবা প্রকৃতির বিরূপ আচরণ মানব জাতির জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। তাই আসুন আমাদের ও নতুন প্রজন্মের জন্য সুন্দর ও নিরাপদ পৃথিবী গড়তে আমরা সকলে হাতে হাত রেখে এখন থেকেই কাজ করার অঙ্গীকার করি।

happy wheels 2

Comments