কারাম মুরা ম্যানগ্রোভ ভিলেজ : আদিবাসী মুন্ডা স্বপ্নযাত্রা

সাতক্ষীরা থেকে আল ইমরান

প্রেক্ষাপট
ভারতের রাচি জেলা থেকে ২৫০ বছর পূর্বে বাংলাদেশে আগত মুন্ডা সম্প্রদায়। এখান থেকে ২৫০ বছর পূর্বে আদিবাসী এ সম্প্রদায়ের মানুষেরা এখানে আসেন বন আবাদ করতে। বন আবাদ শেষ হলে তারা ফেরত যেতে চাইলে এখানকার মানুষেরা আদিবাসীদের এখানে থাকার আহবান জানান। কিন্তু শর্ত দেন এখানে থাকতে হলে পদবি পরিবর্তন করতে হবে। মুন্ডা পদবির পরিবর্তে সরদার হবে। অনেকেই পদবি পরিবর্র্তন করে থেকে যান। যারা পদবি পরিবর্তন করেননি তারা ফিরে যান। সুন্দরবনের একদম কোল ঘেঁষে অবস্থিত কালিঞ্চি গ্রামে ১৮টি মুন্ডা পরিবারের বসবাস, ১৮টি পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা প্রায় ৮০ জন।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মুন্ডাদের জীবনযাত্রা সর্ম্পকিত বিস্তারিতভাবে লিখিত কোন ইতিহাস পাওয়া যায় না। তার কারণ পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের অভাব। মূলতঃ জাতিসত্ত্বার মিথ, সংঙ্গীত, গল্পে ফোটে ওঠে তাদের অতীত ইতিহাস। ভারত বর্ষের উপজাতিদের সম্পর্কে ইনসাইক্লোপডিয়া বা জ্ঞানকোষ থেকে জানা যায়, মুন্ডা হচ্ছে একটা সংস্কৃত শব্দ। যার অর্থ একট গ্রামের প্রধান। মূলতঃ মুন্ডা ভাষায় মুন্ডা বলতে মাথা প্রধানকে বুঝায়। অপরদিকে আদিবাসীদের প্রচীন ভাষা অনুসন্ধান করে দেখা যায়, মুন্ডা সম্পর্কে এ অর্থই বিদ্যমান রয়েছে। আদিবাসীদের তথ্য মতে আরও জানা যায়, মুন্ডা যার অর্থ গাছের শিকড়। তবে এ ব্যাপারটিতে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকমের মত রয়েছে। এ ব্যাপারে কলিঞ্চি গ্রামের মুন্ডা সম্প্রদায়ের প্রবীণ গোপাল মুন্ডা বলেন, “একদা ভারতের রাঁচি জেলার মধ্যে সকল ধর্মের (হিন্দু, মুসলিম, মুন্ডা, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ) সকল লোক একসাথে বসবাস করতো। একদিন রাঁচির রাজা ঘোষণা করনে যে, তিনি প্রত্যেকে সম্প্রদায়ের তাদের পছন্দ অনুযায়ী তাঁর গ্রন্থ থেকে একটি করে গ্রন্থ দিবেন।

received_1879895255660011

রাজা একদিন সকল সম্প্রদায়ের লোকজনদের আমন্ত্রণ জানালেন। রাজার আমন্ত্রণসভায় সব সম্প্রদায়ের লোকজনই সমবেত হলো শুধুমাত্র মুন্ডা সম্প্রদায় ছাড়া। কারণ, তারা ঐ দিন হাড়িয়া মদ্যপানে এতো ব্যস্ত ছিল যে রাজকীয় আমন্ত্রণের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। অন্য সম্প্রদায়ের লোকজন যথা সময়ে এসেছিল এবং তারা তাদের পছন্দমত গ্রন্থ নিতে সমর্থ হলো কিন্তু মুন্ডা সম্প্রদায় এসেছিল পরবর্তী দিনের সকালে। তাদের দেরির জন্য রাজা খুব মর্মাহত হলেন এবং খারাপ শব্দ ব্যবহার করে ভর্ৎসনা করলেন। রাজার ব্যবহারকৃত খারাপ শব্দগুলোর মধ্যে মুড়হা (গাছের মূল শিকড়) শব্দটি ছিল। কিন্তু মুন্ডা সম্প্রদায়ের লোকেরা মুড়হা শব্দটির স্থলে মুন্ডা শব্দটিই তারা বুঝে নিল। এবং তখন থেকেই তারা তাদেরকে মুন্ডা নাম ধারণ করলো।

সাপখালিতে মুন্ডা সম্পর্কে একেবারে ভিন্ন ধরনের আরও একটা গল্প বলা হয়ে থাকে। গল্পটা এরকম-একদা আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়ের লোকজন রান্না ছাড়াই কাঁচা মাংস খেত কিন্তু একবার তারা বনের মধ্যে দু’টি পাথরে ঘর্ষণ লাগিয়ে আগুন জ্বালাতে সক্ষম হলো। তখন আগুনকে আরও প্রজ্জ্বলিত করার জন্যে জ্বালানি হিসাবে গাছের শিকড় ব্যবহার করতে লাগলো। মজার ব্যাপার হলো, তারা জ্বালানি হিসাবে শুধুই শিকড় বা মূলই ব্যবহার করতো। কখনই গাছের শাখা-প্রশাখা ব্যবহার করতো না। আর এই শিকড় বা মূলকে তারা মুড়হা বলতো। এ কারণে, রাঁচির লোকজন এবং রাজা এ সম্প্রদায়কে মুড়হা নামেই ডাকতো। পর্যায়ক্রমিকভাবে, এই মুড়হা বা মূল হলো আদিবাসীদের মধ্যে তারাই মূল বা প্রধান। ঊনিশ শতকে ভারতের জমিদাররা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে সুন্দরবনকে তাদের দখলে পেলে তখন সুন্দরবনের জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য তারা আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায় এনেছিল।

received_1879894975660039

মুন্ডা সম্প্রদায়ের লোকজন প্রায় অনেক আগে থেকে সুন্দরবনে বসবাস করে আসছে। একসময় তারা সুন্দরবনের ঘন জঙ্গলকে হাত দা দিয়ে কেটে কেটে পরিষ্কার করে আবাসস্থল গড়েছিল। এ জন্য একটা জায়গাকে এখনও হাত-কাটা জায়গা নামে ডাকা হয়ে থাকে এবং তারা জায়গার জন্য তখনকার জমিদারকে করও পরিশোধ করতে হয়েছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় আজ তাদের বেশিরভাগ লোকরেই কোন ভূ-সম্পত্তির অধিকার নেই। পরিস্থিতি এখন এমন হয়েছে যে, মুন্ডা সম্প্রদায়ের লোকেরা নতুন কোন আবাস গড়ে তুলবে তেমন জমিটুকুনও নেই। মুন্ডা সম্প্রদায়ের মধ্যে পৈত্রিক সূত্রে জমি শুধু ছেলেদের মধ্যেই ভাগ হয়ে থাকে। সুন্দরবনে পরে আসা বাঙালি সম্প্রদায় নানা রকম কুট-কৌশল করতো মুন্ডা আদিবাসীদের সাথে। ফলে, মুন্ডা আদিবাসীরা প্রায়ই বাঙালিদের দ্বারা প্রতারণার শিকার হতো। বাঙালিরা জাল দলিল বানিয়ে আদিবাসীদের ভূমি দখল করতো। যেহেতু, আদিবাসীরা বাঙালিদরে চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী এবং ভালো বাংলা ভাষা বুঝতো না তাই তাদের অনেক বেশি ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে। এমনকি বাঙালিরা আদিবাসীদের কাছ থেকে বিঘাপ্রতি জমি ক্রয় করলেও তারা মূলতঃ বিঘার স্থলে একর হিসাবেই তা অধগ্রিহণ করতো। ফলে ধীরে ধীরে আদিবাসীরা ভূমিহীন হতে হতে এখন প্রায় সর্বশান্ত পর্যায়ে এসে পড়েছে। যদিও বর্তমানে মুন্ডা আদিবাসীদের অধিকার আদায়ে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে।

কারাম মুরা ম্যানগ্রোভ ভিলেজ নামকরণের যুক্তি
আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়ের মানুষেরা বিশ্বাস করে কারাম নামে তাদের একজন দেবতা আছে। ভাদ্র মাসের শেষে একাদশীতে তারা এ দেবতার পূজা করে। সারারাত এ পূজাটি করার পরে তাদের ধর্ম অনুসারে সকালে এ দেবতাকে নদীতে ডুবাতে হয়। বিগত ২৫০ বছর পূর্বে খুলনা জেলার কয়রা উপজেলায় সারারাত পূজা করার পরে যখন সকালে কারাম দেবতাকে নদীতে ডুবাতে যায় তখন এ সম্প্রদায়ের মানুষেরা গঙ্গা দেবীর সাক্ষাত পেয়েছিল। অর্থ্যাৎ গঙ্গা দেবী মাঝ নদী থেকে হাতছানি দিয়েছিল। আর এ কারণেই মুন্ডা সম্প্রদায়ের মানুষেরা কারাম নামের এ বেদতাকে বিশ্বাস করে এবং ভগবান বলে মানে। এরই প্রেক্ষিতে কারাম শব্দটি এই পর্যটন কেন্দ্রের নামকরণের প্রথমে ব্যবহার করেছেন তারা। এবং মুরা শব্দটির অর্থ হলো মুন্ডা। মুরা শব্দটি এসেছে আদিবাসী শব্দ থেকে। আর যেহেতু সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে পর্যটন কেন্দ্রটি অবস্থিত সুতরাং নামের শেষে ম্যানগ্রোভ ভিলেজ ব্যবহার করেছেন।

ম্যানগ্রোভ ভিলেজের বর্ণনা
কারাম মুরা ম্যানগ্রোভ ভিলেজটি সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবনের একেবারে কোলঘেঁষে বয়ে যাওয়া ধজিখালি নদীর পাড়ে অবস্থিত। ভিলেজটিতে ৯টি কোয়াটারসহ মোট ২৫জন পর্যটকের আবাসিক ব্যবস্থা রয়েছে। ম্যানগ্রোভ ভিলেজটি থেকে সুন্দরবন পর্যবেক্ষণ করার জন্য রয়েছে উচু পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। এছাড়া ছবি তোলা ও ইলেকট্রোনিক্স উপায়ে সংরক্ষণের সু-ব্যবস্থা করেছে পর্যটন কতৃপক্ষ। ম্যানগ্রোভ ভিলেজটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহযোগিতায় এবং রিলিভ ইন্টারন্যাশনাল এর মাধ্যমে নির্মিত হয়েছে। পর্যটন কেন্দ্রটি স্থানীয় মুন্ডা দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। এ থেকে অর্জিত আয় স্থানীয় মুন্ডাদের উন্নয়ন এবং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ব্যয় করা হয়।

যেভাবে একটি ট্যুর পরিচালনা করা হয়
মুন্ডা আদিবাসী মানুষেরা বিভিন্ন মাধ্যমে যেমন ইলেকট্রিক মিডিয়া প্রিন্ট মিডিয়া স্থানীয় জনগণ বিভিন্ন এনজিও ও স্থানীয় সরকার সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে দেশ বিদেশের পর্যটকদের সাথে যোগাযোগ করেন। ম্যানগ্রোভ ভিলেজে আসা পর্যটকদের এই পর্যটন কেন্দ্রের নিজস্ব গাইডারের মাধ্যমে থানা বা জেলা শহর থেকে রিসিভ করা হয় এবং সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থান পর্যবেক্ষণ করানো হয়। এবং সুন্দরবন ভ্রমনের ক্ষেত্রে ভ্রমণকারীদের প্রয়োজনে প্রশাসনের সহায়তা প্রদনের ব্যবস্থা করা হয়। পর্যটকদের সকল সুযোগ সুবিধা দিতে নিবেদিত প্রাণ পর্যটন কর্তৃপক্ষ।

ম্যানগ্রোভ ভিলেজের সুবিধা
এখানে পর্যটকদের জন্য রয়েছে আবাসিক কোয়াটারসহ স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে রান্না ও খাওয়ার ব্যবস্থা। ভ্রমণের জন্য রয়েছে উন্নত মানের ইঞ্জিন চালিত নৌকা যার মাধ্যমে পর্যটকরা সুন্দরবনের অপরূপ ও মায়াভরা দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন। এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য সুন্দরবন বিষয়ক শিক্ষা সফরের আয়োজন করনে পর্যটন কর্তৃপক্ষ।

মুন্ডা সাংষ্কৃতিক চর্চাসমূহ (পর্যটকদের জন্য)
বিনোদনের জন্য স্থানীয় মুন্ডা আদিবাসীর সংঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশনা করেন এ সম্প্রদায়ের সাংষ্কৃতিক টিমের সদস্যরা। যেকোন প্রকার দূর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে এবং সমৃদ্ধি ও কল্যাণের লক্ষ্যে সুন্দরবনের মুন্ডা আদিবাসীরা তাদের পূর্বপুরুষের পালন করা বিভিন্ন পূজাপার্বণ চাঁদপঞ্জিকা অনুযায়ী উদযাপন করে থাকেন। তাঁরা যেমন র্পূব-পুরুষদের সম্মানার্থে প্রতিরাতে ভেতর ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখেন। অবশ্য পূজা উদযাপনের জন্য পরিবারের বা গোত্ররে সবচেয়ে বয়স্ককে নির্বাচিত করা হয়ে থাকে। তবে গ্রামের বড় উৎসবের ক্ষেত্রে সম্প্রদায়ের পাহানকে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। এই সকল ধর্মীয় উৎসব চলাকালীন সময়ে তারা একটা ধুতি, একটা গামছা এবং একটা সুতা পরিধান করে থাকে। পরিবারের প্রধান, গোত্রের সম্মিলিত চাঁদার দ্বারা এ সমস্ত অনুষ্ঠানের খরচপাতি তারা মিটিয়ে থাকেন। এ সব অনুষ্ঠানে তারা ভাতের মদ, হাড়িয়া মদ প্রভৃতি পরিবেশন করে থাকেন।

received_1879895045660032

মুন্ডা আদিবাসীদের পূর্বপুরুষদের প্রতি উৎর্সগিত পূজা যেমন- সোহরী, বুড়ো-বুড়ি এবং সারহুল পূজা মূলতঃ ভেতর ঘর এ সম্পন্ন হয়ে থাকে। বসন্তে নতুন ফলের স্বাগত এবং র্পর্বপুরুষের প্রতি ভক্তি প্রকাশার্থে মূলতঃ সারহুল পূজা অনুিষ্ঠত হয়ে থাকে। আর এ উৎসবের জন্য মুরগি ও মোরগকে বলিদান দেওয়া হয়ে থাকে। পূর্বপুরুষদের আত্মার মাগফিরাতের জন্য বুড়ো-বুড়ি পূজা পালন করা হয়ে থাকে। আর একটি নতুন ঘর নির্মিত হলে মুরগি পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পূর্বপুরুষদের সম্মানার্থে ও ভবিষ্যতের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে মুন্ডা অদিবাসীরা সবচেয়ে বড় আর ব্যয়বহুল পূজা নামে পরিচিত পাহাড়িয়া অথবা বড় পূজা উদযাপন করে থাকে। তবে যেহেতু পূজাটি খুব ব্যয়বহুল, তাই অনেক গোত্ররে লোকেরা এটাতে অনেকসময় অংশগ্রহণ করতে পারে না। আর একটি বড় পূজা হচ্ছে করম পূজা। প্রতি তিন বছর পরপর উদযাপিত হয়ে থাকে। মূলতঃ এটা কুমারী মায়েরাই এ পূজা করে থাকে। তারা এ পূজার মাধ্যমে তাদের সুন্দর স্বামী, সৎ এবং নিষ্পাপ সন্তানাদী আর প্রচুর ফসল এবং গবাদী পশু যাতে পেতে পারেন সে প্রার্থনায় প্রকাশ করে থাকে। ধর্মীয় শাস্ত্রীয় অনুযায়ী, এ পূজার একটা অনুষঙ্গ হচ্ছে, ধানের বীজ, সরিষার বীজ যা পূজা সম্পন্ন করার জায়গাটিতে সাত দিন ধরেই রাখতে হয় এবং অপেক্ষা করতে হয় এ বীজগুলো চারায় রূপান্তরিত হওয়া পর্যন্ত।

এই পূজার সাথে মিথ বা পৌরাণিক কাহিনীর একটা যোগসূত্র রয়েছে। প্রথমত: এই পূজার সপ্তমতম দিনে শাস্ত্রীয়মতে বর্ণনা করতে হবে কিভাবে করম গাছ তাদের র্পূবপুরুষদের জীবন রক্ষা করেছিল, কিভাবেই বা রাজা জঙ্গলে তাদের লুকিয়ে রেখেছিল আর কেনইবা করম গাছকে দেবতার আসনে বসানো হলো। দ্বিতীয়ত: কেন লোকজন এ করম গাছকে পূজা করতে হবে তার ব্যাখ্যা শুনানো। করম দেবতা সর্ম্পকিত একটা গল্প প্রচলিত আছে। মুন্ডা সমপ্রদায়ের লোকদের মধ্যে গল্পটি হলো এরূপ- করমা এবং ধরমা নামে দুই ভাই ছিল। একবার ধরমা একটা স্বপ্ন দেখল, করমা গড বা দেবতা তার কাছে এলো এবং তাকে তাঁর সম্মানে পূজা করতে বললো এবং সে স্বপ্নে তাই করলো যার ফলে সে ফসল আর গবাদীপশুতে তার আঙ্গিনা ভরে গেল আর সে ধনী হয়ে পড়লো। পরবর্তী দিন ধরমা এ কাহিনী করমার নিকট বর্ণনা করলো কিন্তু সে এটা বিশ্বাস করলো না। এ ঘটনার ঠিক কয়েক বছর পর করমা গরিব হয়ে পড়লো অপরদিকে ধরমা ধনী হতে লাগলো। পরিশেষে, করমা বুঝতে পারলো যে, ধরমার কথায় সত্য, তারপর তারা একত্রে এ পূজা করতে শুরু করলো এবং ধরমার মতো করমাও ধনী হয়ে পড়লো। আর সে থেকে করম পূজা পালিত হয়ে আসছে। পূর্বপুরুষের পূজা পার্বণ ও সংস্কৃতির গল্পের পাশাপাশি পর্যাটকদের বিনোদনের জন্য স্থানীয় মুন্ডা আদিবাসীর সংঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশনা করেন এ সম্প্রদায়ের সাংষ্কৃতিক টিমের সদস্যরা।

যোগাযোগ
কারাম মুরা ম্যানগ্রোভ ভিলেজটি সাতক্ষীরা জেলার অর্ন্তগত শ্যামনগর উপজেলার (রমজাননগর ইউনিয়নের) কালিঞ্চি গ্রামে সুন্দরবনের কোলঘেঁষে বয়ে চলা ধজিখালি নদীর পাড়ে অবস্থিত। সাতক্ষীরা জেলা শহর থেকে শ্যামনগর হয়ে মাইক্রো বাসে যেতে সময় লাগে ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট এবং শ্যামনগর থেকে মাইক্রো বাসে যেতে সময় লাগে ৫০ মিনিট। এছাড়াও ভাড়া চালিত মটর সাইকেল এবং অন্যান্য পরিবহন যোগে ভিলেজটিতে পৌছানো যায়। কারাম মুরা ম্যানগ্রোভ ভিলেজটিতে বুকিং ও ভ্রমণের জন্য যোগাযোগের নম্বর গোপাল মুন্ডা +৮৮০১৭৪০৯৭২৮০৯, পরিতোষ মুন্ডা +৮৮০১৯৪১৯৮২৭৬৪।

সম্ভাবনা
দিলীপ কুমার মুন্ডা বলেন, “আমাদের ছেলেমেয়েরা লেখা পড়ায় আগের চেয়ে অনেক এগিয়ে। আগে কেউ স্কুলে যেতে চাইতো না কারণ আমাদের সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়েরা স্কুলে গেলে আমাদের পাশে কেউ বসতে চাইতো না। সবাই আমাদের নিয়ে উপহাস করত কেউ বলত কলু, কেউ বলত বুনো। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন খারাপ নামে ব্যঙ্গ বা বিদ্রুপ হাসি তামাশা করতো। কিন্তুু সেগুলো এখন আর নেই।” তিনি আরও বলেন, “এখন অধিকাংশ ছেলে মেয়ে বিদ্যালয়মূখী হয়েছে। অভাবের তাড়নায় অনেকেই কর্মজীবন বেঁচে নিয়েছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ বনের উপর নির্ভরশীল হলেও বর্তমানে তারা এ থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন। এদের কর্মজীবনের কথা চিন্তা করে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান তাদের সহায়তায় লক্ষ্যে এগিয়ে এসেছে।” বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় এখানে গড়ে উঠেছে কারাম মুরা ম্যানগ্রোভ ভিলেজ। এটার মাধ্যমে এখানে পর্যটকদের আগমনের দ্বারা এখানের কিছু মানুষের স্বচ্ছলতা পেতে শুরু করেছে। বলে রাখা দরকার, এখানে পর্যটকরা এসে সরাসরি সুন্দরবনের মায়াভরা দৃশ্য উপভোগ করার জন্য অত্যন্ত একটি মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া পর্যটকদের রাত্রি যাপনের জন্য গ্রাম্য ফর্মূলায় আরামদায়ক কটেজ তৈরি করে দিয়েছে। নদী ভ্রমণের জন্য রয়েছে উন্নত মানের বোট (নৌকা), বিভিন্ন বিনোদনের জন্য মুন্ডা সম্প্রদায়ের যুবক-যুবতিদের সম্মলিত প্রচষ্টায় গড়ে উঠেছে একটি সাংস্কৃতিক টিম। এ টিমের মাধ্যমে একদিকে যেমন তারা তাদের সাংস্কৃতিটা কিছুটা হলেও টিকিয়ে রেখেছে। ঠিক অনুরূপ তাদের একটি আয়ের উৎস হিসাবে তারা বেছে নিয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে এই পর্যটন কেন্দ্রটির মাধ্যমে।

received_1879895118993358

কারাম মুরা ম্যানগ্রোভ ভিলেজের মাধ্যমে এখানকার মানুষের বন নির্ভরশীলতা কমবে বলে আশা করে এখানের মানুষেরা। দিপালী মুন্ডা বলেন, “এই কারাম মুরা ম্যানগ্রেভ ভিলেজের মাধ্যমে আমরা সুুফল পেতে পারি তবে সেটা সময় সাপেক্ষের ব্যাপার। এখানের আয় আবার অনেকটা নির্ভর করছে বাইরের পর্যটকদের আগমনের উপর।” যাই হোক, যেহেতু এখানে স্বল্পসংখ্যাক পরিবারের বসবাস তাই যদি এই পর্যটন কেন্দ্রটিতে পর্যটকদের আগমন বেড়ে যায় তাহলে বনের উপর তাদের নির্ভরশীলতাটা কমবে। রমেশ মুন্ডার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এই কমিউনিটির অধিকাংশ মানুষ বনজীবী কিন্তু প্রাকৃতিক দূর্যোগ এবং বনে প্রবেশের অনুমতি না থাকায় আমরা প্রায়ই কর্মহীন হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু এই প্রকল্পটি হত্তয়ায় আমরা কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছি যে, এ থেকে আমাদের একটি আয়ের উৎস বের হবে।” বন নির্ভরশীলতা কমাতে অনেকেই এই প্রকল্পে কাজের পাশাপাশি বাড়িতে ছোট পরিসরে সবজি বাগান করার পরিকল্পনার কথা জানান। তারা বলেন, “বর্তমানে স্বল্প পরিসরে সবজি চাষ করছি তবে কারও পরামর্শ পেলে হয়তো আমরা আরো ভালোভাবে করতে পারতাম।”

স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় তারা অনেক সম্পত্তির মালিক ছিলেন। তখন তারা কৃষি কাজ করতেন এবং কৃষির উপর অনেকটা নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তাদের জমি আস্তে আস্তে দখল হতে থাকে আর বর্তমানে তাদের অনেকেই ভূমিহীন। আর এই কারণেই এদের সাথে কৃষির যোগসূত্রতা একেবারে নেই বললেই চলে। এখানকার অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষদের কথা মতে, এখানে মুন্ডা সম্প্রদায়ের মানুষদের টিকিয়ে রাখতে আমাদের সমাজের সকল শ্রেণীর সকল পেশার মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে এবং সমাজের প্রতিটি পদে পদে তাদের পদচারণার মাধ্যমে তাদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সাথে সাথে কালিঞ্চি গ্রামের এই মুন্ডাদের কথা মাথায় রেখে কারাম মুরা ম্যানগ্রোভ ভিলেজ পর্যটন কেন্দ্রটি টিকিয়ে রাখা আবশ্যক বলে মনে করেন এই এলাকার সচেতন মহল।

শেষ কথা
উপকূলীয় সুন্দরবন অঞ্চলের ভূমির আদি সন্তানেরা (মুন্ডারা) এখন ভূমিহীন। ভূমির অধিকার হারানোর পাশাপাশি তাদের জীবনের সুর ছন্দ, সুখ ও শান্তি নিভু নিভু। নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি আজ বিপন্ন। তবে, হাল ছাড়েনি প্রকৃতির আদি সন্তানেরা। নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি ও অধিকার আদায়ে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব সংগঠন। পাশাপাশি, সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ আদিবাসী মুন্ডাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। কারাম মুরা ম্যানগ্রোভ ভিলেজ, আদিবাসী মুন্ডাদের স্বপ্নপূরনের তেমনই এক জীবন-সংস্কৃতি ও অধিকারবান্ধব প্রচেষ্টা।

happy wheels 2

Comments