সাম্প্রতিক পোস্ট

জলাবদ্ধ জমি ব্যবহারে কৃষকের বৈচিত্র্যময় উদ্যোগ

 

 

কলমাকান্দা নেত্রকোনা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা

খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করার জন্য কৃষি জমির উপর কৃষকের প্রবেশাধিকার ও নিয়ন্ত্রণ থাকা অত্যন্ত জরু্রি। কিন্তু কৃষি প্রতিবেশীয় অঞ্চলের ভিন্নতার কারণে হাওর ও হাওর অধ্যূষিত অঞ্চলের কৃষকের কৃষি জমিগুলো প্রায় ৭-৮ (বৈশাখ-অগ্রহায়ণ) মাস পর্যন্ত জলে নিমজ্জিত থাকে। তাই এই সময়কালে কৃষকরা চাষ করতে পারেন না কোন কিছুই । শুধুমাত্র বোরো ফসল ও শীতকালীন শাক সবজি চাষ করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। এমন বিরূপ পরিস্থিতিতেও যেসব কৃষক জলাবদ্ধ জমি ব্যবহার করার ঝুঁকি নিয়েছেন তাদের সেই বৈচিত্যময় উদ্যোগগুলো এখানে তুলে ধরা হল।

কলমি শাক চাষ
কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের ওমরগাও গ্রামের কৃষাণী তাসলিমা বেগমের (৩৮) বসতভিটা ও ফসলী জমি বছরে প্রায় ৬ মাস ( জ্যৈষ্ঠ- কার্তিক) জলে নিমজ্জিত থাকে। স্বামী মো. খোকন মিয়া গ্রামে গ্রামে ঘুরে চুলের বিনিময়ে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়েই তাদের সংসার চলতো খুব দৈন্যতার মধ্য দিয়ে। সম্পত্তি বলতে তিন কাঠা ( ২৪ শতাংশ) ফসলী জমি ও আট শতাংশ জমির উপর বসতভিটা। বর্ষাকালে বসতভিটায় সবজি চাষের কোন জায়গা নেই। সবকিছুই বাজার থেকে ক্রয় করতে হয়। চার সন্তান পড়াশুনা করছে। তাই খরচ বাড়ছে দিন দিন। সংসারের আর্থিক সংকট কমিয়ে আনার জন্য স্বামীর পাশাপাশি আয় করার উদ্দেশ্যে তিনি মনযোগ দেন জমির ব্যবাহার বৃদ্ধি করার দিকে।

WP_20170821_026
আজ থেকে তিন বছর পূর্বের কথা। তার দুই ছেলে পাশ্ববর্তী বিল ও জলাশয়ে বের হয়ে পড়তো অচাষকৃত কলমীশাক কুড়িয়ে আনার জন্য। সেই কুড়িয়ে আনা কলমী শাকের পাতা রান্নার জন্য রেখে ডোগাগুলো তিনি রোপণ করে রাখতেন জমির এক কিনারে। যে কলমী শাকের ডোগা তিনি শুকনো মৌসুমে রোপণ করেছিলেন বর্ষাকালে তিনি দেখতে পান সেগুলো পানির উপর ভাসতে শুরু করেছে। পানির উচ্চতা যত বাড়ছে কলমী শাকও তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করেছে। তখন থেকেই তিনি শিক্ষা নেন ছয় মাস জলে নিমজ্জিত তার তিন কাঠা জমিটি তিনি বর্ষাকালেও ব্যবহার করতে পারবেন। সেই থেকেই শুরু হয় বর্ষাকালে কলমী শাক চাষ করা। এখন তিনি ১৮০-২০০/- টাকার কলমী শাক বিক্রি করেন প্রতিদিন।

WP_20170821_009
তিনি বলেন, “শুকনা মৌসুমে এই জমিতে মরিচ, মুলা শাক, পুই শাক, চাল কুমড়া চাষ করতাম কিন্ত বর্ষাকালে কোন কিছুই চাষ করতাম না। যহন থেইকা কলমী শাক চাষ করার পদ্ধতি শিখছি হের পর থেইকা চাষ করা আর থামাইনা। এখন সারাবছরই আমি আমার জমি কাজে লাগাইতে পারতাসি।” তিনি আরও বলেন, “কলমী শাক চাষে কোন পরিশ্রম নাই। প্রথম প্রথম সারা জমিতে ডোগা লাগাইয়া দিসি। এর পর থেইক্যা বর্ষাকালে নিজে থেকেই এহন হইতে শুরু করে। এর আগা যত কাটি ততই আরো ডাল ছাড়ে, আরো বেশি ছড়ায়। কলমী শাক বিক্রি কইরাই বাচ্চাদের পড়াইতাছি, চাল, ডাল, ঔষধ কিনতাছি।” রৌদ্রময় দিনে প্রচন্ড রৌদ্রের উত্তাপে পানি গরম হয়ে গেলে মাছগুলো কলমী গাছের নীচে আশ্রয় নেয় তখন তারা সেখান থেকেই বড়শী দিয়ে মাছ ধরে দৈনিক মাছের চাহিদা মিটান। এছাড়া পানি শুকাতে শুরু করলে জমির পানি নিস্কাসনের মাধ্যমে এই জায়গাই জড়ো হওয়া অনেক মাছ সংগ্রহ করেন। এই মাছগুলো তারা বর্ষাকালের জন্য শুকিয়ে রাখেন। যা ৩-৫ মাসের মাছের খাদ্য চাহিদা পূরণ করে।

তার বড় ছেলে বায়েজিদ (১৩) মুন্সিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণীতে পড়াশুনা করে। সে জানায় মা প্রতিদিন কলমী শাক কাইট্টা নৌকায় তুইল্যা দেয়, আর আমি স্কুল ছুটির পর বিকাল বেলা প্রতিদিন বাজারে নিয়া বেচি। এখন আমার খাতা, কলম কেনা আর প্রাইভেটের টাকার জন্য সমস্যা হয়না। দুদিন কলমী শাক বিক্রি করলেই আমার প্রাইভেটের ৩০০/- জোগার হয়ে যায়।

ধইঞ্চা চাষ 
তাসলিমা বেগমের প্রতিবেশী কৃষক মো. আব্দুল্লাহ (৫৫)। তারও জমি প্রতিবছরই ৬ মাস জলে নিমজ্জিত থাকে। তিনি তার জলাবদ্ধ জমিতে ধইঞ্চা চাষ করেন প্রায় ৫-৬ বছর ধরে। তিনি বলেন, “আমার ৮ কাঠা (৬৪ শতাংশ) জমিটা বর্ষাকালে কোন কাজে লাগেনা। তাই ধইঞ্চা যেহেতু পানিতেই ভালো হয় হেই কারণে ৫-৬ বছর আগে পরীক্ষামূলক ধইঞ্চা চাষ কইরা ভালো ফল পাইসি। বন্যা আইলেও ধইঞ্চার কোন ক্ষতি হয় না। কারণ ধইঞ্চা ১০-১৫ ফিট পর্যন্ত লম্বা হয়।” ধইঞ্চার উপকারিতা সম্পর্কে তিনি জানান, ধইঞ্চা রোপণ করাতে তার জমিতে আগাছা জন্মাচ্ছেনা, মাটির ক্ষয়রোধ হচ্ছে, জ্বালানির চাহিদা মিটাচ্ছে। এর পাতাগুলো পড়ে মাটির উর্বরাশক্তি বাড়াচ্ছে, গাছের নীচে জমা হওয়া শ্যাওলা খাওয়ার জন্য মাছ আসে, পানি বেশি গরম হয়ে গেলে এই জায়গাই আইসা মাছ আশ্রয় নেয়। এর ফুল, ফল খাওয়ার জন্য অনেক বাবুই পাখি আসে।

 

Exif_JPEG_420

জলে নিমজ্জিত জমি ব্যবহারের চর্চা কৃষকগণ শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি। অন্যেরা জানতে চাইলে তারা এই বিষয়ে সহভাগিতা করছেন। তাই কৃষাণী তাসলিমা বেগমের কাছ থেকে দেখে আরো ৫-৭ জন কৃষক জলে নিমজ্জিত জমিতে কলমী শাক চাষ করছেন এবং কৃষক মো. আব্দুল্লাহর কাছ থেকে দেখে আরো ৬ জন কৃষক ধইঞ্চা চাষ করে জলে নিমজ্জিত জমির উপযুক্ত ব্যবহার করছেন বলে জানান।

মাঁচায় সবজি চাষ
কৃষাণী আম্বিয়া খাতুনের (৩২) বসতভিটার চারপাশ এমনকি উঠান পর্যন্ত জলে নিমজ্জিত থাকে বছরের ৬ মাস। তার বাড়ির ভিতরটাই শুধু সামান্য উচু। কিন্তু একটু বন্যা হলেই বাড়িতেও পানি প্রবেশ করে। তিনটি ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে প্রায় জলের মাঝে বসবাস করেন তিনি। তার ফসলী জমি ও বাড়ীর আঙিনা একসাথেই। তাই ঘরের জন্য সামান্য উচু করা ভিতেই তিনি সবজি চাষ করে পানির উপর মাঁচা তৈরি করে দিয়েছেন। তাতে যা সবজি (চাল কুমড়া, ধুন্দল, পুইশাক) হয় তা দিয়েই তার বর্ষাকালীন ৬ মাসের সবজির চাহিদা মিটে যায়।

যাদের ফসলী জমি জলে নিমজ্জ্বিত থাকে তাদের এই উদ্যোগগুলো অনুসরণ করে জলাবদ্ধ কৃষি জমির নিবিড় ব্যবহার উপযোগী করতে পারে। সেইসাথে পারিবারিক খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে খাদ্য সার্বভৌমত্ব অর্জনকে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।

happy wheels 2