ভেষজ শিক্ষক আব্দুর রব কবিরাজ

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী

নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার বলাইশিমূল ইউনিয়নের নোয়াদিয়া গ্রামের এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ভেষজ শিক্ষক আব্দুর রব কবিরাজ। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে আব্দুর রব সবার বড়। সেনাবাহিনীর চাকরি দিয়ে পেশাজীবন শুরু করেন আব্দুর রব। এরপর সেবাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি নোয়দিয়া একতা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ছোটবেলা থেকে দাদুর কাছে ভেষজ ঔষধি গাছ চেনা, বিভিন্ন রোগের ঔষধ তৈরি ও ব্যবহার সম্পর্কে হাতেখড়ি হয় তাঁর। এলাকার কারো অসুখ-বিসুখে তিনি ভেষজ চিকিৎসা দেন, বিনিময়ে তিনি কোন টাকা নেননা। তিনি গ্রামের আরও পাঁচজনকে ভেষজ উদ্ভিদ ও এর ব্যবহার পদ্ধতি সম্পর্কে শিখিয়েছেন। এভাবে তিনি প্রতিনিয়ত মানুষের রোগ-ব্যাধি এবং গাছ-গাছড়ার ভেষজ গুণাগুণ ও ভেষজ চিকিৎসা নিয়ে ভাবতে থাকেন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। চিকিৎসা করতে গিয়ে প্রয়োজনীয় ঔষধি গাছ-গাছালি না পাওয়ায় চিকিৎসার কাজ করতে গিয়ে তাকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। কালের বিবর্তনে অনেক ঔষধি উদ্ভিদ বিলুপ্তির উপক্রম। সেনাবাহিনীর চাকুরি ছেড়ে দিয়ে বাড়ি এসে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে ১০০ জাতের ঔষধি গাছ ও লতাগুল্ম সংগ্রহ করে নিজের ৩০ শতাংশ জমিতে ঔষধি উদ্ভিদের বাগান করেছেন। চাষকৃত ঔষধি উদ্ভিদ দিয়ে তিনি অনেক মানুষকে নিয়মিত বিনামূল্যে ভেষজ চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। কবিরাজ আব্দুর রব একজন পাখি প্রেমিকও বটে। তার বাড়ির চারপাশে শতবর্ষী গাছ আছে ১০টি এবং সেগুলো তিনি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করেন। শতবর্ষী এসব গাছ শতশত পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব গাছে আশ্রয় নেওয়া পাখিগুলো তিনি কাউকে শিকার করতে দেন না।

Kabiraj Ab. Rob
আব্দুর রব তৈরিকৃত ভেষজ ঔষধ ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়ায় এলাকায় একজন কবিরাজ হিসাবে তিনি মানুষেরর আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তার ঔষধি বাগান দেখতে তাঁর বাড়ি যায়। তার ঔষধি বাগান দেখে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভেষজ উদ্ভিদ ও ভেষজ চিকিৎসা সম্পর্কে এক ধরনের অনুপ্রেরণা জাগে। কবিরাজ আব্দুর রব নোয়দিয়া একতা উচ্চ বিদ্যালয় ও আশুজিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ঔষধি গাছ ও বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় এগুলোর ব্যবহার বিষয়ে আলোচনা করেন। ৩০/৩৫টি ঔষধি উদ্ভিদ সাথে নিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে সেগুলোর সাথে পরিচিতি করান এবং এর গুণাগুণ ও ব্যবহার বিষয়ে ধারণা দেন ও ঔষধি বৃক্ষ রোপণে তাদের উদ্বুদ্ধ করেন। এভাবে দীর্ঘদিন যাবত গ্রামের অসহায় মানুষদের তিনি বিনামূল্যে/নামমাত্র মুল্যে জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন। কবিরাজী কাজে আগ্রহী এমন দু’জন লোককে ভেষজ চিকিৎসায় তার অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা ও কৌশল শিখিয়ে দক্ষ কবিরাজ হিসাবে গড়ে তুলেছেন। তিনি নিয়মিত ছড়া, শুলক, খনার বচন ও গাছ নিয়ে গান-কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়ে বৃক্ষ রোপণ, গাছের গুণাগুণ এবং সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে তথ্য দিয়ে থাকেন। এলাকার মানুষদের সাথে স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক আলোচনা, বৃক্ষ রোপণ, গাছ-গাছড়ার গুণাগুণ ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি এ বছর নোয়াদিয়া একতা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে ৫০টি বিভিন্ন ধরণের ঔষধি গাছের চারা বিতরণ করেছেন।

Medicinal plant garden
ভেষজ বা কবিরাজী চিকিৎসা যুগ যুগ ধরে মানুষ ও গবাদী পশু-পাখির চিকিৎসায় চলে আসছে। মানুষ তাদের প্রয়োজনে হাজারো প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদ সংরক্ষণ করে আসছে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এখনও ভেষজ চিকিৎসানির্ভর। অভিজ্ঞ ও দক্ষ কবিরাজের ভেষজ ঔষধ ব্যবহার করে অনেক মানুষ বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পাচ্ছে। ভেষজ উদ্ভিদ ও ভেষজ চিকিৎসা বিষয়ে অনেক গবেষক ও ভেষজ চিকিৎসা চর্চাকারীগণ বিভিন্ন সময়ে অনেক প্রকাশনা বের করেছেন। সেগুলোর পড়ে অনেক লোক ভেষজ চিকিৎসা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করছে এবং মানুষকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলছেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে অনেক কবিরাজ (ভন্ড) ঝাড়ফুক দিয়ে জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা দেওয়ার নাম করে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করছে। এমনকি চিকিৎসার নাম করে অনেক শিশু ও নারীদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। তাই ঝাড়ফুকের চিকিৎসাকে বর্জন করে ভেষজ ঔষধের সঠিক ব্যবহার ও চর্চায় অভিজ্ঞ কবিরাজ বা হেকিমদের এগিয়ে আসতে হবে। ভেষজ চিকিৎসকগণের সুবিধার্থে সাধারণ জনগোষ্ঠীকে এসব ব্যবহার্য ভেষজ ঔষধ সংরক্ষণ করতে হবে। তবেই বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার পাশাপাশি ভেষজ চিকিৎসার মাধ্যমে মানব সমাজ বিভিন্ন রোগ থেকে উদ্ধার পাবে। আব্দুর রবের মত কবিরাজগণ সমাজে ও রাষ্ট্রের কাছে গ্রহণীয় হবে।

happy wheels 2

Comments