প্রকৃতির ঘণ্টা : তক্ষক আজ বিলুপ্তির পথে

প্রকৃতির ঘণ্টা : তক্ষক আজ বিলুপ্তির পথে

সাতক্ষীরা থেকে আসাদুজ্জামান সরদার

গুজবে কান দিয়ে নিধন করায় প্রকৃতির ঘণ্টা তক্ষকের আজ বিলুপ্তির পথে। অতি বিলুপ্তি নিরীহ সরিসৃপ প্রাণির মধ্যে একটি প্রাণি তক্ষক। আর আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কোন রোগ নিরাময়ে তক্ষকের তেলের ভূমিকা নেই দাবি করেছে প্রাণিবিদরা। তবু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গুজবে কান দেওয়ার মতো কিছু হুজুকে বাঙালি রাতারাতি বড় লোক হওয়ার আসায় ছুটছে তার পিছনে। পরিবেশবান্ধব তক্ষক সাপ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। আর সেই গুজবে পরিবেশের অন্যতম অকৃত্রিম বন্ধু এ তক্ষর সাপ অনুসন্ধানে নেমে পড়েছে একটি মহল। তারা গোপনে বিভিন্নস্থান থেকে সংগ্রহ করছে এই তক্ষক। তবে এর ক্রেতা কারা তা নিশ্চিত বলতে পারছে নাগোয়েন্দা সংস্থা ও সংশ্লিষ্টরা।

মুক্ত বিশ্বকোষ উইউকিপিডিয়া সূত্রে জানা গেছে, তক্ষক (Gecko) Lacrtilia বর্গের Gekkonidae গোত্রের একটি গিরগিটি প্রজাতি। বাংলাতে এই প্রাণিটি অঞ্চলভেদে তক্ষক, গিরগিটি, রক্তচোষা, আনজিলা, শান্ডা প্রভৃতি নামে পরিচিত। পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীরা একে বলেন টক-কো। প্রাণির শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী তক্ষক ল্যাসারটিলিয়া বর্গের গেকোনিডি গোত্রের একটি গিরগিটি জাতীয় প্রাণি। পিঠের দিক ধূসর, নীলচে-ধূসর বা নীলচে- ধূসর বা নীলচে বেগুনি-ধূসর। সারা শরীরে থাকে লাল ও সাদাটে ধূসর ফোঁটা। পিঠের সাদাটে ফোটাঁগুলো পাশাপাশি ৭-৮টি সরু সারিতে বিন্যস্ত। কমবয়সী তক্ষকের লেজে পরপর গাঢ়-নীল ও প্রায় সাদা রঙের বলয় রয়েছে। মাথা অপেক্ষাকৃত বড়, নাগের ডগা চোখা ও ভোতা। চোখ বড় বড়, মণি ফালি গড়নের। লেজ সামান্য নোয়ানো। নাকের ডগা থেকে পা পর্যন্ত এদের দৈর্ঘ্য প্রজাতি ভেদে ১২-১৫ সে.মি এবং লেজও প্রায় ততটা।

তক্ষকের ডাক চড়া, স্পষ্ট ও অনেকে দূর থেকে শোনা যায়। ডাকের জন্যই এই নাম। কক্ধসঢ়;কক্ধসঢ়; আওয়াজ দিয়ে ডাক শুরু হয়, অতঃপর ‘তক্ধসঢ়;- ক্ক’ ডাকে কয়েক বার ও স্পষ্টস্বরে। এবং টক্কো শব্দে ডাক শেষ হয়। সম্ভবত এরূপ ডাকের জন্য এদের ‘তক্ষক’ নামকরণ করা হয়েছে। অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, তক্ষকরা কীটপতঙ্গ, ঘরের টিকটিকি ছোট পাখি ও ছোট সাপ খেয়ে থাকে। পুরাতন বাড়ির ছাদের পাশের ভাঙা ফাঁক-ফোঁকড় বা বয়স্ক গাছের ফোকড়ে বাস করে। ব্যাপক নিধনই বিপন্ন হওয়ার কারণ। অনেকে ভুলক্রমে তক্ষককে বিষাক্ত সরীসৃপ হিসেবে চিহ্নিত করে। কিন্তু এরা খুবই নিরীহ অতি বিপন্ন প্রজাতির সরীসৃপ জাতীয় একটি বন্য প্রাণি। বিপন্ন এ প্রাণিটির বসবাস বাংলাদেশসহ আশপাশের অনেক এলাকা যেমন ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্পুচিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশে। বর্তমান হিসেব অনুযায়ী ৬০০ এর কাছাকাছিতক্ষক রয়েছে। তক্ষকের প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এদের অবদান অনস্বীকার্য।

এ বিষয়ে সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক অলিউর রহমান বলেন, “প্রকৃতির ঘণ্টা হিসেবে পরিচিত এ প্রাণিগুলো পুরাতন বসতবাড়ি থেকে শুরু করে অনেক জায়গায় বসবাস করে। ছাদের পাশের ভাঙ্গা ফাঁক ফোকর বা গর্ত, গাছের গর্ত বিশেষ করে পুরোনো বটগাছে থাকে এরা। এদের ডাক শুনেছে গ্রাম-বাংলার হাজারো মানুষ। কিন্তু চোখে দেখেছে এ রকম লোকের সংখ্যা হাতে গোনা। কারণ দিনের বেলায় এদের বিচরণ সীমিত।” তিনি আরও বলেন, “এরা কীটপতঙ্গ, ছোট টিকটিকি, পতঙ্গের লার্ভা প্রভৃতি ভক্ষণ করে। অধিকাংশ কীটপতঙ্গ ও তাদের লার্ভা উৎপাদিত ফসলের জন্য ক্ষতিকারক হওয়ায় তাদেরকে ভক্ষণকারী হিসেবে তক্ষক একটি উপকারী প্রাণি। পরভোজী প্রাণি হিসেবে এরা জৈবিক দমন পদ্ধতির এজেন্ট। প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রে এদের উপস্থিতি অনিবার্য। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় এই প্রাণিটি বর্তমানে বিপন্ন প্রাণির তালিকায়। বিশ্বব্যাপী এর প্রজাতি সংখ্যা আশংকাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। পরিবেশবিদরা এটিকে সংরক্ষণের কথা বলছেন।”

তিনি বলেন, “সম্প্রতি একটি অসাধু, কুচক্রীমহল একটি ৩০০-৩৫০ গ্রাম ওজনের তক্ষকের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে ১-২ কোটি টাকা। তাদের অপপ্রচার এই প্রাণিটির দৈহিক অংশবিশেষ ব্যবহৃত হবে প্রাণঘাতি রোগ নিরাময়ে। ধারণাটি প্রাচীনও বটে। যে কারণে আমরা আজও শহরে, বন্দরে ও হাট বাজারে কিছু লোককে দেশীয় চিকিৎসার উপকরণ হিসেবে শান্ডার তেল বিক্রি করতে দেখি। সেখানে আরো দেখি অসংখ্য তক্ষক বা এ জাতীয় প্রাণিকে আগুনে জ্বালিয়ে তেল প্রস্তুতের দৃশ্য। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে মালিশের মাধ্যমে ব্যাথা বেদনা উপশম, শক্তি বৃদ্ধি প্রভৃতি কাজে এটি ব্যবহারের পরামর্শ দেন ঐ সকল ঘৃণ্য তথাকথিত হেকিম বা কবিরাজরা।” তিনি আরও বলেন, “ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে অনেকে এটি ব্যবহারও করেন। আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কোন রোগ নিরাময়ে এ জাতীয় তেলের ভূমিকা নেই। তাছাড়া বিশ্বব্যাপি চিকিৎসা বিজ্ঞান গবেষণায় কোথাও অদ্যাবধি তক্ষকের তেলের ব্যবহার প্রমাণিত হয়নি। অথচ একটি কুচক্রী মহল গুজব ছড়িয়ে এই বিপন্ন বন্য প্রাণিটির হত্যাযজ্ঞে সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করছে। সহজেই অঢেল অর্থের মালিক হওয়ার আশায় এরা নেমে পড়েছে তক্ষক নিধনে। চাহিদা অনুযায়ী অর্থ পেতে হলে ৩০০-৩৫০ গ্রাম ওজনের তক্ষক সরবরাহ করতে হবে। বিরল ঘটনা ছাড়া এদের কারোরই ওজন বাস্তবে ২০০-২৫০ গ্রামের অধিক নয়। এ কারণে যারা এই প্রাণিটি ধরছে তারা কাক্সিক্ষত ওজন না পেয়ে হত্যা করছে সেটাকে। এভাবেই বিপন্ন এই বণ্য প্রাণিটি প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হওয়ার পথে।”

satkhira pic (1)সদরের দহাকুলা এলাকার রফিকুল ইসলাম ও কালিগঞ্জ উপজেলার ইশারত হোসেন বলেন, “জনশ্রুতি রয়েছে হুজুকে বাঙালি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জিনিসের পিছনে ছুটে থাকে এক সময় সীমানা পিলার, কালো বিড়াল, হুতুম পেঁচা,বজ্রাঘাতে নিহত ব্যক্তির লাশ পর্যন্ত কবর থেকে উঠিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সেই রকমই তক্ষক সাপের ঘটনা গুজবে কান দিয়ে মানুষ ছুটছে তক্ষকের পিছনে। অন্যের কথা শুনে চিলের পিছনে পিছনে দৌড়ানোর মতো ঘটনা। এটি গুজব ছাড়া কিছু নয়।”

নাম প্রকাশ না করা শর্তে একজন মৎস্য ঘের ব্যবাসয়ী ও একজন সাবেক চেয়ারম্যান সিমানা পিলার ও তক্ষক সাপের পিছনে ছুটে সর্বশান্ত হয়েছেন। সিমানা পিলার ও তক্ষক সাপের পিছনে ছুটে সর্বশান্ত হওয়ার পর তারা ভুল বুঝতে পেরেছেন। নিছক গুজব ছাড়া আর কিছু না। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবুল হোসেন বলেন, “বাংলাদেশে বণ্যপ্রাণি সংরক্ষণকল্পে প্রণীত বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ অধ্যাদেশ অনুযায়ী এ জাতীয় যে কোন বণ্যপ্রাণি শিকার, হত্যা বা বিক্রি দন্ডনীয় অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও এই কর্মকান্ডে সে আইনের প্রয়োগ এখনো চোখে পড়ার মত নয়। বরং কথিত রয়েছে অনেক আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এই গুজবে কান দিয়ে অর্থেল পিছনে ছুটছে। এটি বন্ধ রোধে সকলকে সচেতন হওয়ার দরকার। পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। অথচ আমাদের কাছে সে বিষয়টি আজও উপেক্ষিত।” বন্যপ্রাণি নিধন না করে সংরক্ষণে আমরা সকলেই এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, “মানবসৃষ্ট এবং নানাবিধ প্রাকৃতিক কারণে সুস্থিত পরিবেশের জন্য অপরিহার্য এ সকল জীব বর্তমানে ক্রমবিলুপ্তির পথে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আমাদের গ্রহটি বাসযোগ্যতা হারাতে পারে।

পৃথিবী নামের এ গ্রহ থেকে তক্ষকসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। অথচ এদের সংরক্ষণ ও বিলুপ্ত রোধে আমাদের রয়েছে সচেতনতার অভাব। শিকারীদের দ্বারা যথেচ্ছ নিধন, বন্যপ্রাণিদের প্রতি নির্মম নিষ্ঠুুরতা এবং হৃদয়হীন ব্যবসায়ীদের অবৈধ রপ্তানি কর্মকান্ড এ প্রক্রিয়াকে আরো ত্বরান্বিত করছে। সাম্প্রতিক সময়ে অন্যান্য প্রাণীর সাথে যোগ হয়েছে তক্ষক নামের এক প্রকার নিরীহ সরিসৃপ। মূল্যবান ঔষধ তৈরির কথা বলে এক শ্রেণির প্রতারক প্রতারণার জালবিস্তৃত করে এই প্রাণিটির ধ্বংসযজ্ঞে এতটাই মনোনিবেশ করেছে যে এদের বিলুপ্তিও সময়ের ব্যাপার মাত্র। পরিবেশ ও প্রকৃতি সুরক্ষায় সকল প্রাণির অবস্থান নিরাপদ হোক এ প্রত্যাশা করেন তিনি। সাতক্ষীরা ৩৮ বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) শামসুল আলম বলেন, “তক্ষকের বিষয়ে আমাদের কোন ধারণ ছিল না। তক্ষক উদ্ধারের পর খুলনা বন বিভাগের এক কর্মকর্তাকে আনা হয় এবং তার ভাষ্যমতে ১৭ ইঞ্চি একটি তক্ষকের বাজার মূল ১ কোটি টাকা। আটক করা তক্ষকের দৈঘ্য ছিল সাড়ে ১২ থেকে ১৩ ইঞ্চি এবং ওজনছিল ২০০-২৫০ গ্রাম। সে হিসাব অনুযায়ী উদ্ধারকৃত তক্ষকের মূল্য ৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা ধরা হয়।” সাতক্ষীরার সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মারুফ আহম্মদ বলেন, “একটি চক্র গুজবে কান দিয়ে রাতারাতি বড় লোক হওয়ার আশায় তক্ষকের পিছনে ছুটছে। এই চক্রকে ধরতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।” এই চক্রটি আগের মতো আর নেই বলেও তিনি দাবি করেন।

happy wheels 2

Comments