পরান পাখি

:: নেত্রকোনা থেকে রনি খান

Untitlfgded‘সোয়া চান পাখি, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছো নাকি’ গানটি নেত্রকোনা বিরহী বাউল সাধক উকিল মুন্সী’র এবং হুমায়ূন আহমেদ ও বারী সিদ্দিকি’র কল্যাণে বহুল পরিচিত একটি বাউল গান। লক্ষ্য করবার মতো বিষয় হচ্ছে গানটিতে ব্যবহৃত ‘সোয়াচান পাখি’ উপমাটি। স্বঘোষিত এবং স্বীকৃত ‘বিরহী’ উকিল মুন্সী তার বিরহ প্রকাশের জন্য এই উপমাটিই ব্যবহার করেছেন। শুধু তাই নয় বাউলকূল শিরোমণি লালন সাইজির ‘রাত পোহালেই পাখি বলে দে রে খাই, দে রে খাই’ অথবা মৈমনসিংহ গীতিকার মহুয়া পালার ‘হাঁস মারলাম, কইতর মারলাম, বাচ্যা মারলাম টিয়া’ আলাল-দুলাল পালার ‘তুমার কাছে শপ্যা গেলাম আমার পুষা পাখি’ এই ‘পাখি’ সংবলিত বহুল ব্যবহৃত উপমাগুলো আমাদের একটি বিশেষ একটি দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

বাংলার লোকসংগীতে এরকম ভুড়ি ভুড়ি উদাহারণ আছে। যেমন- সীতালং ফকিরের ‘সোয়া উড়িল উড়িল জীবের জীবন… নিজ দেশে যাইবে পাখি পুরিলে মেয়াদ’ হাছন রাজার ‘পিঞ্জরায় সামাইয়া রে ময়না ছটফট ছটফট করে’ রাধারমনের ‘পালিতে পালিছলাম পাখি দুধ কলা দিয়া, যাইবার কালে নিষ্ঠুর পাইখ্যে না চাইল ফিরিয়া’ এই ধরনে উদাহরণগুলোতেও ‘পাখি’ শব্দটির ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বাউল সাধনার অন্যতম বিষয় যে ‘আত্মা’ সেই আত্মার উপমা হিসেবেও তারা পাখি সংবলিত ‘পরান পাখি’ উপমাটি ব্যবহার করেছে। এবং আরও মজার বিষয় হচ্ছে পাখিকে উপমা করে যতগুলো গান লোকসংস্কৃতিতে পাওয়া যায় তার প্রায় সবগুলোই বিপুল জনপ্রিয়।

কখনো নিজের অতি আপনজনের জন্য ‘পোষা ময়না’ বা ‘সোনার ময়না পাখি’ কখনো বিচ্ছেদের যন্ত্রনায় নীল হয়ে ‘বেঈমান পাখি’ আবার কখনো বা দূর পরবাসী প্রিয়জনের সাথে মিলনের জন্য আত্মার আর্তনাদ ‘আমি যদি পাখিরে হইতাম’ এই ধরণের পাখি সংবলিত উপমা।

এই যে লোকসংগীতে ‘পাখি’র এমন বাহারী ব্যাবহার এর নিশ্চয় একটা কারণ আছে। আর সেই কারণটি হচ্ছে পাখির সাথে মানুষের সম্পর্ক। অতি প্রাচীনকাল থেকেই পাখির সাথে মানুষের একটি গভীর, নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কোরআন শরীফে বর্ণিত দুর্জন ধংসকারী ‘আবাবীল’ পাখি, হযরত নূহ (আঃ) এর নৌকার কবুতর, হযরত শাহ জালালের ‘জালালী কইতর’ অথবা শান্তির প্রতীক সাদা কবুতর কিংবা ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র ‘কালা কইতর’গুলো এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পশু-পাখিদের মধ্যে সম্ভবত পাখির অবস্থানই মানুষের সবচেয়ে নিকটতর। অন্তত বাংলার লোকসংস্কৃতি সে স্বাক্ষ্যই দেয়। আর সে কারণেই তো বাংলার মানুষ তার আপনজনের উপমায়, নিজের আত্মার উপমায়, তার জাতশত্রুর উপমায় ‘পাখি’র নামটিই বিশেষভাবে ব্যবহার করেছে।

বর্তমানে আমরা কিন্তু সেই উপমাটির ব্যবহার করতে পারছি না। মূলত এর পেছেনের বাস্তবভিত্তিক কারণটি হচ্ছে, পরিসংখ্যান বলছে ‘গত দু’দশকে বিলুপ্ত হয়েছে ৩০ প্রজাতির পাখি। এর মধ্যে সোনালি শির প্রজাতিটি পৃথিবী থেকেই বিলুপ্ত’ (তথ্যজাল- উইকিপিডিয়া)।হিসাবে দেখা যায় প্রতিবছরে ১.৫টি প্রজাতির পাখি হারিয়ে যাচ্ছে। সন্দেহ নেই পরিসংখ্যানটি ভয়াবহ।

যেহেতু আমাদের সামনে ‘পাখি’ই নেই সেহেতু আমাদের সৃষ্টিশীল মানুষেরা আর পাখিকে গান-কবিতার ভাষায় ব্যবহার করতে পারছে না। এটি হচ্ছে এর বাস্তব কারণ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মূলত পাখি কেন প্রয়োজন।

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন গবেষণায় দেখিয়েছেন পাখি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। উদাহারণ হিসেবে একটি বহুল প্রচলিত শব্দমালা বলা যায় ‘পাখি প্রকৃতির ঝাড়ুদার’। গবেষকরা যাকে বলছেন ‘ইকোলজিক্যাল ইনভায়রনমেন্ট’ সেখানে পাখির ভূমিকাটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এবং তারা গবেষণায় এ কথাও বলেছেন বাংলার প্রকৃতিতে পাখি একটি অন্যতম অনুষঙ্গ।

মূলতঃ পাখি বিলুপ্তির অনেকগুলো কারণের মধ্যে পাখির বাসস্থান ধবংস, পাখি শিকার অবশ্যই একটি বড় কারণ। কিন্তু তার চাইতেও বড় কারণ হচ্ছে ‘সবুজ বিপ্লব’ বাণিজ্য। IRRI, এর সাথে রাসায়নিক সার, তার সাথে কীটনাশকের শুভাগমন পাখির পক্ষে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘ইউক্যালিপটাস’ জাতের গাছগুলো এদের অন্যতম অস্ত্র। এই সমস্ত অস্ত্র বাণিজ্যিক অস্ত্র প্রয়োগের ফলে ‘তাদের’ হলো শুরু পাখিদের হলো সারা।

কিন্তু বাংলার প্রাকৃতজন যারা, ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় বাণিজ্যের বিরুদ্ধে তারা সবসময়ই সোচ্চার থেকেছেন। পাকিস্তান আমলে ইরি ধানকে তারা স্বাগত জানিয়েছিলেন এভাবে-

‘আওলা-ঝাওলা পাকিস্তান

আইলো ইরি ধান

ইরি ধানের গন্ধে

নয়া ভাবি কান্দে।’

খুবই মজার বিষয় যে সাম্রাজ্যবাদী বাণিজ্যের কবলে পড়ে পাখি, পরিবেশ ধবংস হতে চলেছে, সেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকেও তারা ‘ঈগলের নখ’ হিসেবে নিয়েছেন। ‘ঈগলের নখরে বিক্ষত জাতীয় পতাকা’।

আমরা আমাদের প্রিয় স্বদেশকে ‘পাখি ডাকা, ছায়া ঢাকা’ ‘আমের বনে ঘ্রাণে পাগল’ সবুজ-শ্যামলিমার স্বরূপে দেখতে চাইলে অবশ্যই তাকে পাখির বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। কারণ এই দেশ লালনের-হাছনের, এই দেশ মৈমনসিংহ গীতিকার, এই দেশ এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের, প্রাকৃতজনের, এই দেশ আমাদের। এ ক্ষেত্রে নেত্রকোনা’র বিচিপাড়া গ্রামের পাখি প্রেমী আঃ রশিদ ফকির অনুকরণীয় হতে পারেন। তিনি যেভাবে তার শোবার ঘরটি পর্যন্ত অবাধ-উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। অক্লান্ত শ্রমে-ঘামে তার বাড়িটিকে ‘পাখি বাড়ি’ হিসেবে তৈরি করে তুলেছেন।

খাচায় পোষা তোতা নয়, মুক্ত আকাশের বলাকার অবাধ বিচরণযোগ্য হোক আমাদের প্রিয় স্বদেশ। শামসুর রাহমানের ‘একটি পাখি’র মতো অগণিত পাখি ফিরে আসুক তাদের শান্তির নীড়ে।

happy wheels 2

Comments