সহজ উপায়ে ভেজাল সার সনাক্তকরণ
?????????????

সহজ উপায়ে ভেজাল সার সনাক্তকরণ

এবিএম তৌহিদুল আলম 

বাংলাদেশে ষাটের দশকের শুরু থেকে সারের ব্যবহার শুরু হয়। বর্তমানে বাজারে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপিসহ ১০৭ প্রকার সার বিক্রি হয় (সরেজমিনে ভেজাল সার সনাক্তকরণ পদ্ধতি: মৃত্তিকা সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সেবা প্রকল্প, মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউট, কৃষি মন্ত্রণালয়, ২০১৫) । এই বিপুল সংখ্যক হরেক রকমের সারের মধ্যে ভেজাল সার বিক্রি ঘটনাও খবরে আসে। আইন-নীতিমালার ফাঁক গলে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ভেজাল সার উৎপাদন ও বিপণনের মাধ্যমে সাধারণ কৃষককে প্রতারিত করে আসছে। এতে শুধু কৃষকই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এমন নয় জমির উর্বরতা ও ফসলের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতেও।

ভেজাল সার নিশ্চিতভাবে চেনার উপায় হচ্ছে গবেষণা বা পরীক্ষাগারে রাসায়নিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সারের সঠিক উপাদানের পরিমাণ জানা। মাঠ পর্যায়ে সারের গুণগতমান নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সংস্থা বিভিন্ন সরকারি গবেষণাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে গুণ নিয়ন্ত্রণের কাজ করা হয়। পরীক্ষাগারে সারের রাসায়নিক পরীক্ষার পাশপাশি মাঠ পর্যায়ে ভেজাল সারের সনাক্তকরণ প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউট দীর্ঘ দিনের সারের নমুনা পরীক্ষা করার অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও গবেষণালব্ধ ফলাফল বিশ্লেষণ করে মাঠ পর্যায়ে ভেজাল সার সনাক্তকরণের সহজ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। গবেষণাগারের রাসায়নিক বিশ্লেষণ ছাড়াও কিছু সহজ পদ্ধতি অনুসরণ করে সংশ্লিষ্ট সারের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা সম্ভব যা সহজেই কৃষকরা নিজেরাই করতে পারেন।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ইউরিয়া সার বেসরকারিভাবে উৎপাদন হয় না। ইউরিয়া উৎপাদনে ব্যাপকভাবে সরকারি ভর্তূকি প্রদানের ফলে দাম অন্যান্য সারের চেয়ে তুলনামূলক কম। ইউরিয়া সারে সাধারণত তেমন ভেজাল পাওয়া যায় না। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে গরং নৎধহফরহম সনাক্ত করা গেছে। অর্থাৎ এক প্রকার ইউরিয়া সারের প্যাকেটের মধ্যে অন্য প্রকার ইউরিয়া সারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

?????????????খুব সহজেই ভেজাল ইউরিয়া সার সনাক্ত করা যায়। একটি মোটা পুরত্বের ভালো পলিব্যাগে ১ চামচ ইউরিয়া সারের সাথে মাটি ও সমপরিমাণ খাবার চুন মিশিয়ে পলিব্যাগের মুখ শক্ত করে বেঁধে ১-২ দিন রেখে দিতে হবে। তারপর ব্যাগের মুখ খোলা হলে অ্যামোনিয়ার তীব্র গন্ধ বের হবে। আরেকটি পরীক্ষা হলো ১ চামচ (১ গ্রাম) ইউরিয়া সার ২ চা চামচ পরিমাণ পানির মধ্যে দিলে তাৎক্ষণিকভাবে গলে স্বচ্ছ দ্রবণ তৈরি করবে। এ দ্রবণে হাত দিলে ঠান্ডা অনুভূত হবে।

 

টিএসপি প্রস্তুত করা হয় রক ফসফেট নামক খনিজ পদার্থের সাথে ফসফরিক এসিডের বিক্রিয়ার মাধ্যমে। বাংলাদেশের এই সার বেসরকারি পর্যায়েও উৎপাদন করা হয়। বিভিন্ন কারখানায় নানা প্রকার ভেজাল টিএসপি সার তৈরি হয়। আবার অনেক সময় সরকারি নির্দেশে উল্লেখিত পুষ্টি উপাদানের চেয়ে কম পুষ্টি উপাদানের সম্পন্ন টিএসপি আমদানির প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়।

বাড়িতে বসেও টিএসপি সার ভেজাল কিনা তা পরীক্ষা করা যায়। ১ চা চামচ টিএসপি সার আধা গ্লাস ঠান্ডা পানিতে মিশালে ভেজালহীন সার সম্পূর্ণ গলে গিয়ে ডাবের পানির মত দ্রবণ তৈরি হবে। পক্ষান্তরে ভেজাল টিএসপি সার পানিতে মিশালে ঘোলা দ্রবণ তৈরি করে। ভালো মানের টিএসপি সার অধিক শক্ত বিধায় বুড়ো আঙ্গুলের নখের মাঝে রেখে চাপ দিলে সহজে ভেঙে যাবে না। কিন্তু ভেজাল টিএসপি অপেক্ষাকৃত নরম হওয়ায় নখের মাঝে নিয়ে চাপ দিলে সহজে ভেঙে যাবে। আবার ভেজাল টিএসপি সারের ভাঙা ভিতরের অংশের রঙ বিভিন্ন রকমের হয়।

?????????????

মিউরেট অব পটাশ বা এমওপি হলো বাংলাদেশে প্রচলিত পটাশ সারের মধ্যে অন্যতম। সামান্য পরিমাণ এমওপি সারের সাথে মিহি ও মোটা বালি লাল রঙ করে মিশিয়ে সাধারণত ভেজাল এমওপি সার তৈরি করা হয়। কখনো কখনো এমওপি সারের সাথে মিহি কাঁচের গুড়া মিশিয়ে ভেজাল এমও পি সার তৈরি করা হয়। আবার কখনো সামান্য পরিমাণ এমওপি সারের সাথে খাবার লবণ মিশিয়ে লাল রঙ করে ভেজাল এমওপি সার তৈরি করে বাজারজাত করা হয়।

 

আবার আধা চামচ এমওপি সার আধা গ্লাস পানিতে মিশালে ভেজালমুক্ত সঠিক এমওপি সার সম্পূর্ণ দ্রবীভূত হয়ে পরিষ্কার দ্রবণ তৈরি করবে। কিন্তু সারের নমুনায় কিছু অদ্রবণীয় বস্তু যেমন বালি, কাঁচের গুড়া, মিহি সাদা পাথর, ইটের গুড়া ইত্যাদি মেশালে তা আকারে গ্লাসের নিচে জমা হবে। সারের নমুনায় অন্য কোনো লাল বা অন্য কোনো রঙ মিশালে পানির রঙ সেই অনুযায়ী হবে এবং রঙ ভেসে উঠবে। স্পর্শ করলে হাতে রঙ লেগে যাবে। প্রকৃত এমওপি ?????????????সারের দ্রবণটি স্বচ্ছ এবং হালকা লাল রঙ এর হবে। হাতের আঙুল অথবা টিস্যু পেপার ডুবানো হলে হাতের আঙ্গুল বা টিস্যু পেপারে কোনো রঙ লেগে থাকবে না। অন্য আরও একটি সহজ পরীক্ষা হলো আধা গ্লাস পানিতে ৫ চা চামচ পরিমাণে এমওপি সার গলিয়ে ৫ মিনিটি পর গ্লাসের গায়ে হাত দিলে খুব ঠান্ডা অনুভূত হলে নমুনাটি প্রকৃত এমওপি সার। অন্যদিকে অধিক লবণ বা ম্যাগনেশিয়াম সালফেট দিয়ে তৈরি ভেজাল এমওপি সারের পানির দ্রবণে কম ঠান্ডা অনুভূত হবে। ২-৩ চা চামচ এমওপি সার খোলা অবস্থায় ১২-২৪ ঘণ্টা বাতাসে রেখে দিলে যদি নমুনাটি ভিজে ওঠে তবে ধারণা করা যেতে পরে যে, নমুনাটিতে খাবার লবণ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। খাবার লবণ বাতাস থেকে জলীয়বাষ্প শোষণ করার ফলে গলে যায়। প্রকৃত এমওপি সার বাতাসে রাখলে ভিজে উঠবে না।

বিভিন্ন জৈব উৎস থেকে প্রাপ্ত জৈব উপাদান পচিয়ে জৈবসার তৈরি করা হয়। বাজারে প্রাপ্ত জৈব সারে দেওয়া ভেজালের প্রকৃতি ও মাত্রা বহুমাত্রিক। অনেকটা নিয়ন্ত্রণবিহীন অবস্থায় যে যার খেয়াল খুশিমত জৈব সার তৈরি করে বাজারজাত করছে। যদিও সরকার ইতোমধ্যে জৈব সারে জৈব কার্বন, কার্বনও নাইট্রোজেন অনুপাত, পুষ্টিউপাদান, ভারী বস্তু, অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে মানদন্ড নির্ধারণ করেছেন। সাধারণত মাটির সাথে সামান্য পরিমাণ গোবর মিশিয়ে কালো রঙ দিয়ে যন্ত্রের সাহায্যে দানাদার জৈব সার তৈরি করা হয়। ?????????????কিংবা জৈব সার তৈরির উৎস গোপন রেখে বিভিন্ন জৈব বর্জ্যে কালো রঙ, চুন মিশিয়ে জৈব সার তৈরি করে বাজারজাত করা হয়।

প্রকৃত জৈব সারের রঙ হবে গাঢ় ধুসর থেকে লাল। মান সম্পন্ন জৈব সারে কোনো প্রকার দূর্গন্ধ থাকবে না। সঠিক আর্দ্রতা সম্পন্ন (১৫%-২০%) সম্পন্ন জৈব সার হাতের মুঠোয় চাপ দিলে দলা বাধবে না। ২ চা চামচ পরিমাণ জৈব সার আধা গ্লাস পানিতে মিশিয়ে একটি দন্ড নিয়ে ক্রমাগত নেড়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, প্রকৃত জৈব সারের নমুনায় ক্ষেত্রে খুব সামান্য অদ্রবনীয় বস্তু যেমন মাটি, বালি, কাঁকর ইত্যাদি গ্লাসের নিচে জমা। উল্লেখিত অদ্রবনীয় বস্তুর পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেলে ধরে নিতে হবে যে, জৈব সারের নমুনায় অতিরিক্ত অদ্রবনীয় বস্তু মেশানো হয়েছে।

বর্তমানে সার রাসায়নিক কৃষির অন্যতম অনুসঙ্গ। সার পরীক্ষার এই সহজ পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করে মাঠ পর্যায়ে খুব সহজেই ভেজাল নির্ধারণ করা সম্ভব। এতে করে কৃষকের আর্থিক ক্ষতিও জমির মাটির ক্ষতি উভয়ই এড়ানো সম্ভব।

happy wheels 2

Comments