লবণের আগ্রাসন থেকে বাঁচতে কৃষিতেই ফিরছেন কৃষকরা

লবণের আগ্রাসন থেকে বাঁচতে কৃষিতেই ফিরছেন কৃষকরা

সাতক্ষীরা থেকে মফিজুর রহমান ও বাবলু জোয়ারদারঃ 

লবণ পানির ঘেরের কারণে এলাকার মানুষকে পূবর্ পুরুষের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে। কারণ ১০ বিঘার একটি চিংড়ি ঘেরে সারাবছর একজন কর্মচারী হলেও চলে। কিন্তু ১০ বিঘার কৃষি জমিতে এক মাস ৩৩ জন লোক কাজ করতে পারে। বর্ষাকালে জমি চাষ, রোয়া, ধান লাগানো, ঘাস বাছা, ধান কাটা ও মাড়াই করার জন্য তিনজন মানুষের ৩ মাস ভালোমত কাজ হয়। কিন্তু চিংড়ি ঘেরে ৩৩ জন লোকের কাজ একজন মানুষ করছে। এর ফলে ৩২ জন মানুষকে কাজের জন্য পেশা পরিবর্তন করে অন্য এলাকায় কাজের জন্য যেতে হচ্ছে। কৃষি কাজ ছেড়ে মানুষ এখন দূর দূরান্তের ইটভাটায়, মাটির কাজ, ভ্যান চালানোসহ বিভিন্ন কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। বছরে নয় মাস পুরুষদের বাইরে থাকতে হচ্ছে। ফলে অভিভাবকশূন্য পরিবারটির সব দায়িত্ব পড়ছে নারীর উপর। কাজের জন্য বাইরে থাকা পুরুষেরা সময় মত সাংসারিক খরচ বাড়িতে পাঠাতে পারছে না। ফলে নারীদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সন্তানসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের জীবনধারণের জন্য অর্থ উপার্জন করার দায়িত্ব ওই নারীকে নিতে হচ্ছে।

1
“লবণ পানির ঘেরের কারণে এ অঞ্চল থেকে তিতির, কাঠ ময়ূর, বালিহাঁস, লাল মাছরাঙ্গা, ডাক, চন্দনা, হরিয়াল, ব্যাং, সাপ, বেজি, শামুক, স্থানীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও পাখিসহ অসংখ্য প্রাণবৈচিত্র্য হারিয়ে গেছে।” একান্ত আলাপচারিতায় এভাবেই লবণাক্ততার প্রভাব বর্ণনা করছিলেন সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চল শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের গড়কুমারপুর গ্রামের ইউপি সদস্য (প্যানেল চেয়ারম্যান) ইসরাত জাহান মিন্টু (৪৮)। তিনি আরও বলেন, “নিশুতি রাতে ডাহুকের মিষ্টি ডাক এখন আর শোনা যায় না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভেসে আসতো ঘুঘুর ডাক। এখন আর সে ডাক শোনা যায় না। কয়েক প্রজাতির ঘুঘু পাখিও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ঝাকে ঝাকে বাবুই পাখির হাত থেকে ক্ষেতের পাকা ধান রক্ষা করতে পাহারা দিতে হতো সারাদিন। সেই বাবুই পাখি এখন আর চোখে পড়ে না। আগের দিনে গরম কালে আকাশে উড়তো চাতক পাখি। বলা হত চাতক উড়লে বৃষ্টি হবে। সে চাতকের এখন আর দেখা মেলে না। কমে গেছে শিকারি পাখি চিলের সংখ্যা। ছো মেরে কখন নিয়ে যাবে হাঁস-মুরগির বাচ্চা- এ নিয়ে ভাবতে হয় না বাড়ির গৃহিনীদের। প্রকৃতির সুইপার শকুন এবং পানির সুইপার বলে খ্যাত গুই সাপের দেখা মেলা দায়। কালবৈশাখী ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়ে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যেত বকের দল, সে দৃশ্য আর দেখা যায় না”।

সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুর সবুর সানা বলেন, “লবণ পানির ঘের শুরু হওয়ার আগে পদ্মপুকুর ইউনিয়নের সব গ্রামে প্রত্যেক পারিবারেই হাঁস, মুরগি, ভেড়া, ছাগল ও গরু, মহিষ পালন করা হতো। কিন্তু গ্রামের চারিদিকে লবণ পানির ঘের হওয়ায় গবাদিপশু-পাখির খাদ্য, অ-চাষকৃত উদ্ভিদ, চারণভূমি ও সুপেয় পানির উৎস বিনষ্ট হয়ে যায়। ফলে বিলুপ্তির পথে প্রাণবৈচিত্র্য। বিপন্ন হচ্ছে প্রান্তিক জনজীবন”।

2
লবণের আগ্রাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য স্থানীয় মানুষেরা আবার তাদের পূর্ব পুরুষের পেশা তথা কৃষিকাজের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন সম্প্রতি। লবণ পানির ঘের শুধুমাত্র কৃষিপেশাকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেয়নি বরং প্রাণ ও প্রকৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ তা উপলদ্ধি করে স্থানীয় এলাকার মানুষেরা লবণ ঘেরে কৃষিকাজ শুরু করেছেন। এই প্রসঙ্গে গড়কুমারপুর গ্রামের প্রাক্তন ইউপি সদস্য নারগিস পারভিন ঝর্ণা (৪৬) বলেন, “আমি ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এলাকার জমির মালিকদের সাথে আলোচনা করতে থাকি লবণ পানির ঘের বন্ধ করে ফসল চাষ করা যায় কিনা? ১ বিঘা জমিতে বছরে ৫ হাজার টাকা হারি পাওয়া যায়। বছরে দুইবার যদি ফসল ফলানো যায় এবং ফসলের সাথে সাদা মাছ চাষ করা যায় তাহলে আমরা অনেক লাভবান হবো। আলোচনার এক পর্যায়ে জমির মালিকরা লবণ পানির ঘের করার জন্য জমি আর হারি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাস থেকে লবণ পানির ঘের করার জন্য নতুন করে জমি হারি না দিয়ে ১৬০০ বিঘা জমি কৃষি কাজের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে।”

মঞ্জিলা বেগম বলেন, “বসত ভিটা ছাড়া আমার কোন জমি নাই। লবণ পানির ঘের শুরু হওয়ার পর এলাকায় কাজ না থাকায় আমার স্বামীকে বাইরে কাজ করতে যেতে হতো । বছরে ৬-৯ মাস কাজের জন্য বাইরে থাকতে হতো। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাস থেকে লবণ পানির ঘের বাদ দেওয়ার ফলে আমরা ২ বিঘা জমি হারি নিয়ে বর্ষা মৌসুমে ধান চাষ করেছিলাম।” তিনি আরও বলেন, “যে ধান পেয়েছি তাতে আমার সংসারের ৯ মাসের খোরাকি হয়ে যাবে। গরমের ধান করতে পারলে সারাবছরের খোরাকি নিয়ে আর চিন্তা করতে হতো না। তাছাড়া এলাকায় ধান চাষ হওয়ার ফলে কাজের জন্য আর আমার স্বামীকে বাইরে যেতে হচ্ছে না। আমার স্বামী সন্তানকে নিয়ে এখন সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারছি।”

কামরুল ইসলাম বলেন, “আমি ৪ বিঘা জমি হারি নিয়ে এক সাথে সাদা মাছ ও ধান চাষ করেছি। ৪৫ মণ ধান পেয়েছি এবং সাদা মাছ বিক্রি করে অনেক লাভবান হয়েছি। পদ্মপুকুর ইউনিয়নের গড়কুমারপুর গ্রামের পাতালের পানি মিষ্টি তাই আবার গরমের ধান ও লাগিয়েছি।”

3
কৃষক আনিছুর রহমান বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে কৃষি জমিতে লবণ পানি উঠিয়ে চিংড়ি চাষ করার ফলে জমির মাটিতে লবণাক্ততা বেড়েছে। জমির লবণাক্ততা কাটতে একটু সময় লাগবে। কয়েকটি বর্ষা মৌসুম গেলে জমির মাটির উপরের অংশ ধুয়ে আস্তে আস্তে জমির লবণাক্ততা কেটে যাবে।”

জলবায়ু পরিবর্তন এবং মনুষ্য সৃষ্ট নানান প্রতিবন্ধকতার জন্য দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি পেশাজীবী জনগোষ্ঠী কোনো প্রকার ভূমিকা না রাখলেও তারাই ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাবের শিকার। বাংলাদেশের উপকূলীয় দক্ষিণ-পশ্চিাঞ্চলের স্থানীয় কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর জীবনযাত্রা পুনঃগঠনে স্থানীয় জনগণের উন্নয়ন পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা জরুরি। লবণাক্ত মাটি-পানি-পরিবেশ-প্রতিবেশে যে সকল প্রাণসম্পদ টিকে থাকার সক্ষমতা রয়েছে সে ধরনের সহযোগিতা স্থানীয়দের বেঁচে থাকার জন্য ভীষণ জরুরি। পাশাপাশি নোনা মাটি ব্যবস্থাপনায় সুপেয় পানির সেচ ব্যবস্থাপনা ও জৈব ব্যবস্থাপনা সহযোগিতা লবণাক্ত দুর্যোগ মোকাবেলায় করে স্থানীয় মানুষের বেঁচে থাকার শক্তি-সাহস ও সংগ্রামকে আরো বেশি শক্তিশালী ও উদ্যোগী করে তুলবে।

happy wheels 2

Comments