স্বর্ণ-কিশোরী তনিমা

তানোর, রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার

বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠির এক-চতুর্থাংশ হলো কিশোর-কিশোরী। যাদের মধ্যে সচেতনতার হার তুলনামূলকভাবে কম এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা সহিংসতা এবং অবজ্ঞার শিকার। কিশোর-কিশোরীর ক্ষমতায়ন, অধিকার, সচেতনতা এবং উন্নয়নের অন্তরায়সমূহ চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তবেই সুষম উন্নয়ন সম্ভব। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এবং কিশোর-কিশোরীদের মূলধারায় সম্পৃক্তকরণ অনস্বীকার্য। এ বিষয়টি অনুধাবন করে সরকার কিশোর-কিশোরীদের ক্ষমতায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

shorno kishori-3

সরকারের এ সকল কর্মকান্ডের অংশীদার হওয়ার লক্ষ্যে স্বর্ণ-কিশোরী নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এর সহায়তায় কিশোর-কিশোরীদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। বিস্ময়কর হলেও এটা সত্য যে, সমাজে এমন কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি, যেখান থেকে কিশোর-কিশোরীরা তাদের বয়োঃসন্ধি বয়সের প্রতিকূলতা মোকাবেলায় পরামর্শ পেতে পারে। প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সেবার অভাবে কৈশোর বয়সে তারা অনেক সময় নানা রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। যা আমাদের সমাজ প্রায়ই অগ্রাহ্য করে থাকে। শারীরিক সমস্যার মধ্যে রক্তশূন্যতা, পুষ্টিহীনতা, মাসিক সম্পর্কে ভীতি, অজ্ঞতা ও বয়োঃসন্ধি ব্যবস্থাপনায় অপরাগতার মতো নানা ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। অনুরূপভাবে, মানসিক সমস্যার মধ্যে বিষন্নতা, একাকিত্ব, আত্মহত্যার প্রবণতা, অনাকাঙ্খিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া ইত্যাদি লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের কিশোর কিশোরীদের এ অবস্থা অনুধাবন করে ২০১২ সালে ‘স্বর্ণ-কিশোরী নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশন’ কিশোর-কিশোরী বয়োঃসন্ধি স্বাস্থ্য, অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সমাজ উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে তাঁদের গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। স্বর্ণ কিশোরী নেটওয়ার্ক টেলিভিশন, আইসিটি, মিডিয়া, ক্লাব, কমিউনিটি পিয়ার এডুকেশন, ক্লাসরুমভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও দল গঠনের মাধ্যমে কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছে।

একজন তনিমার গল্প
রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার মোহর গ্রামে জন্ম তনিমার। বর্তমানে মোহর উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত। সে পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে গোল্ডেন ‘এ’ প্লাস অর্জন করে। বাবা মো. আহসান হাবীব একই বিদ্যালয়েরই করণিক পদে চাকুরী করেন। মা মোসা. জালেকা বেগম একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকুরি করেন। ছোট বেলা থেকেই মেয়ের কবিতা আবৃত্তি, নাচ, চিত্রাংকনে আগ্রহ দেখে মা-বাবা উৎসাহ দিয়ে স্কুল পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়। ছোট থেকেই প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে নানা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরষ্কারও লাভ করে। পাশাপাশি বাড়িতে চলতো নিয়মিত অনুশীলনের কাজ।

sharno kishori-2

এরপর মাধ্যমিক পর্যায়ে এসে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে উপলক্ষে অনুষ্ঠিত চিত্রাংকন, কবিতা আবৃত্তি, একক অভিনয়, সামাজিক বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রণ করে বিজয়ী হয়। ২০১৬ সালে মোহর উচ্চ বিদ্যালয়ে বারসিক ও স্থানীয় যুব সংগঠন ‘স্বপ্ন আশার আলো’ সংগঠনের আয়োজনে পরিবেশ বিষয়ক স্কুল কুইজ ও উপস্থিত বক্তৃতায় ১ম স্থান অর্জন করে। এরপর তনিমার উপস্থিত বক্তৃতা, নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি, একক অভিনয়ের পারদর্শিতা দেখে তার পরিবার ও তানোর উপজেলা শিল্পকলা একাডেমিতে যোগাযোগের মাধ্যমে শিল্পকলা একাডেমিতে ভর্তির ব্যবস্থা করেন।

Shrno kishori-4

তনিমার শিল্পকলা একাডেমিতে যোগদানের ব্যপারে তানোর সাহিত্য পরিষদ মূখ্য ভূমিকা পালন করে। এ বিষয়ে তানোর সাহিত্য পরিষদের সভাপতি অসীম কুমার সরকার বলেন, “তনিমার মেধা ও পারদর্শিতা দেখে আমার সব সময়ই মনে হয়েছিল যে, এই মেয়ে একদিন তানোর উপজেলার নাম সারাদেশে ছড়িয়ে দিবে। তাই আমরা শিল্পকলা একাডেমি ও তানোর সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত সকল ধরনের প্রতিযোগিতায় তাকে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিই। শিল্পকলা একাডেমীতে যোগদানের পর শুরু হয় তনিমার নতুন অধ্যায়। এখানে বিভিন্ন জাতীয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সাফল্যের সাথে তার মেধার আত্মপ্রকাশ হতে থাকে। পাশাপাশি যোগ হয় সমাজের বিভিন্ন সমস্যা যেমন বাল্যবিবাহ, মাদক ও যৌতুক বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে পথ নাটকে কাজ করার সুযোগ। সেখানেও ছিল তার মেধার বহিঃপ্রকাশ। তার সাফল্যর ঝুলিতে যোগ হতে থাকে বিভিন্ন পুররুষ্কার ও সন্মাননা।

স্বর্ণ কিশোরী তনিমা
উপজেলা শিল্পকলা একাডেমিতে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ও সাফল্য অর্জন করায় তানোর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস থেকে রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার তালন্দ ইউনিয়নের মোহর উচ্চ বিদ্যালয়কে স্বর্ণ-কিশোরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়। প্রাথমিক বাছাইয়ে সফলতা অর্জন করার জন্য জেলা পর্যায়ে প্রতিযোগিতার সুযোগ পায়। সেখানেও সফলতা অর্জন করে। এরপর দেশের ৬৪টি জেলার স্বর্ণ-কিশোরীরা যোগ দেন ঢাকায় সুফিয়া কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্সে স্বর্ণ-কিশোরী জাতীয় কনভেনশনে নিজেদের জেলা ও বিভাগকে আলোকিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে। সেখানে বাল্য বিবাহ সম্পর্কে উপস্থিত বক্তৃতা, বাল্য বিবাহ ও পুষ্টি বিষয়ে উপস্থিত কুইজ, শব্দ প্রতিযোগিতা, মাদক ও যৌতুক এর ক্ষতিকর দিক নিয়ে উপস্থিত বক্তৃতায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজশাহী বিভাগ থেকে লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায় তনিমা। এরপর ৮টি বিভাগেরর ১৬জন অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে বাল্য বিবাহ, মাদক, যৌতুক, পুষ্টি এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যা বিষয়ে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে রাজশাহী বিভাগ থেকে ২য় স্থান অধিকার করে তনিমা।

sharno kishori-1

পুরষ্কার সম্মাননা
বিভাগীয় স্বর্ণ কিশোরী হিসেবে ২য় স্থান অধিকার করায় স্বর্ণ-কিশোরী ফাউন্ডেশন থেকে ১২ হাজার টাকার শিক্ষা বৃত্তি ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনামূল্যে উচ্চ শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। এর পাশাপাশি তাকে ফাউন্ডেশন থেকে আয়োজিত বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সমাজের তথা দেশের উন্নয়ন ও সচেতনতা মুলক কাজ করার জন্য সুযোগ রয়েছে।

তথ্য সহায়িকা: স্বর্ণ-কিশোরী সুস্বাস্থ্য বার্তা (স্বর্ণ-কিশোরী নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশন)

happy wheels 2

Comments