সম্পর্কের মালা গাঁথে বসন্ত বরণ

সম্পর্কের মালা গাঁথে বসন্ত বরণ

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী

বসন্ত আসে, বসন্ত যায়, বদলে যায় মানুষের মন, ফুটে নানান রঙের ফুল, প্রকৃতি সাজে অপরূপ সাজে, প্রকৃতির সাথে দোলে মানুষের মন, দক্ষিণ হাওয়ায় বদলে যায় পরিবেশ। কিশোর-কিশোদের মনে লাগে আনন্দের ঢেউ, প্রজাপতির মত রঙিন পাখায় ভর করে উড়ে যেতে চায় দূরে কোথায়ও। আনন্দে উৎসবে মেতে উঠে মানুষ। বৈচিত্র্যময় উৎসব ও অনুষ্ঠান সকলকে একত্রিত করে, মানুষের মনকে আন্দোলিত করে তোলে, জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে মানুষে মানুষে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটায়। মানুষ একদিনের জন্য হলেও ভুলে যায় ভেদাভেদ। বসন্ত প্রাণ ও প্রকৃতিকে ভালোবেসে সকলের সহঅবস্থানের মাধ্যমে একত্রে মিলেমিশে বসবাস করতে শিখায়। তাইতো গ্রাম বাংলার মানুষ যুগ যুগ ধরে প্রকৃতি ও ঋতু নির্ভর সংস্কৃতি চর্চা করে আসছে।

20180213_122358-W600

যদিও বর্তমান প্রজন্মের বিশেষভাবে নতুন প্রজন্মের মানুষ বাংলা বর্ষ পঞ্জিকায় তেমন অভ্যস্ত নয়, তারা ইংরেজি বর্ষ পঞ্জিকাতেই বেশি অভ্যস্ত। শিক্ষিত ও নিরক্ষর জনগোষ্ঠী উভয়ের ক্ষেত্রেই এটি সমভাবে প্রযোজ্য। বর্তমান সময়ে প্রবীণ ও গ্রামীণ নিরক্ষর বা অল্প শিক্ষিত জনগোষ্ঠীই এখনও একটু আধটু বাংলা পঞ্জিকায় মেনে চলে। হিন্দু ধর্ম বিশ্বাসী বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখনও বাংলা বর্ষ পঞ্জিকা অনুসরণ করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও ব্যবসায়িক কর্মকান্ড করতে দেখা যায়। বাঙালি জনগোষ্ঠী বর্তমানে বিশেষ বিশেষ দিনে বাংলা পঞ্জিকা বা বাংলা মাসের কথা স্মরণ করে, যেমন- পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুনে বসন্ত উৎসব, চৈত্র সংক্রান্তি ইত্যাদি।

শহরাঞ্চলে এসব দিন ঘটা করে উৎসবের আমেজে পালন করা হয়, কিন্তু গ্রামাঞ্চলের মানুষ পালন তো দূরে থাক মনেও করেনা। অবশ্য এর মূল কারণ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অসামর্থতা। অথচ একসময় আমাদের কবি সাহিত্যিকগণ এই বসন্ত নিয়ে অসংখ্য গান, কবিতা ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন, শিল্পীরা গেয়ে উঠেছেন ‘আজি এ বসন্তে, কত ফুল ফোটে, কত বাঁশি বাজে’ এমন অনেক গান। বর্তমান ও নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলা বর্ষ পঞ্জিকা অনুসরণ ও ব্যবহারের গুরুত্ব তুলে ধরা এবং চর্চায় তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে বারসিক’র মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের ফচিকা গ্রামের যুব ও কিশোরীদের উদ্যোগে গ্রাম পর্যায়ে আয়োজন করা হয় বসন্ত উৎসব।

20180213_121340-W600
গ্রামের এক প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী নারী নুরজাহান বেগম গ্রামের যুব ও কিশোরীদেরকে গাদা ফুল দিয়ে সাজিয়ে বসন্ত বরণ অনুষ্ঠানটি উদ্বোধন করেন। ফচিকা গ্রামের শেফালি, সোনিয়া, লাবণী, স্মৃতি, দিপালি, কথা, কমা, শিমু নামের অনেকেই বসন্ত উৎসবে নিজেদের বাসন্তী রঙের শাড়ি ও নানান রঙের ফুল ও ফলে সজ্জিত করে এবং বসন্তের গান গেয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় বসন্ত বরণের জন্য জমায়ত হয়। স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিসহ (মেম্বার), গ্রামের বিভিন্ন বয়সের নারী, পুরুষ, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী ও শিশুরা অনুষ্ঠানে উৎফুল্ল মনে অংশগ্রহণ করেন।

অনুষ্ঠানে তারা গান গেয়ে, কবিতা আবৃত্তি করে, কুইজ প্রতিযোগিতা, চেয়ার খেলা, বল নিক্ষেপ ইত্যাদি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিনব্যাপী আনন্দ করে। সকলে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা উপভোগ করে বসন্তের প্রথম প্রহর। অনুষ্ঠান শেষে ৬ জন কিশোরী নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজ আয়োজিত ২২তম বসন্তকালীন সাহিত্য উৎসবে প্রথমবারের মত যোগ দিতে চলে যায়। সাহিত্য উৎসব থেকে তারা পছন্দের বই সংগ্রহ করে।

20180213_120534-W600
কিশোরী লাবণী আক্তার বলেন, “আজ আমরা গ্রামের সকলে মিলে আনন্দ করতে পারলাম। আমাদের আনন্দ বা বিনোদনের কোন স্থান নেই, আজ আমরা মা-বাবা, দাদী-দাদা সকলকে নিয়ে একসাথে বসন্ত উপভোগ করতে পেরে আমার খুব ভালো লাগছে।”

গ্রামের প্রবীণ কৃষক হায়দার আলী বলেন,“সবাই মিলে আনন্দ করা মানে আমাদের সম্পর্ককে আরো শক্ত করা। আমরা ইংরেজি ক্যালেন্ডার ব্যবহার করায় বাংলা বসন্ত কখন আসে কখন যায় সে সর্ম্পকে আমাদের ধারণা এখন কম। আজ গ্রামে ছেলেমেয়েদের বসন্তবরণ অনুষ্ঠান আয়োজন আমার খুব ভালো লেগেছে।”

অনুষ্ঠানটি আয়োজনের ফলে গ্রামের কিশোর-কিশোরী ও যুবরা শাড়ি পড়ে মা-বাবার সামনে এসে আনন্দ করতে পারায় বাংলা বর্ষ পঞ্জিকার পহেলা ফল্গুনের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পেরেছে। বসন্তবরণ উৎসবের মধ্য দিয়ে তারা পরস্পরের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পেরেছে।
অনুলিখন-র্শকর ¤্রং

happy wheels 2

Comments