সাম্প্রতিক পোস্ট

ইতিহাস সমৃদ্ধ মিষ্টি কাঁচাগোল্লা

ইতিহাস সমৃদ্ধ মিষ্টি কাঁচাগোল্লা

নাটোর  থেকে অমিত সরকার

নাটোরের ‘কাঁচাগোল্লা’ শুধু একটি মিষ্টির নামই নয়, একটি ইতিহাসেরও নাম। আনুমানিক আড়াই’শ বছর পূর্বেও নাটোরের কাঁচাগোল্লার কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। সুপ্রাচীনকাল থেকে মিষ্টি রসিকদের রসনা তৃপ্ত করে আসছে এই মিষ্টি। ১৭৫৭ সাল থেকে এই মিষ্টি ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে। নামে কাঁচাগোল্লা হলেও এ মিষ্টি কাঁচা নয়; আবার গোলও নয়।

উৎপত্তি ইতিহাস

KacaGollaএ মিষ্টির উৎপত্তি ইতিহাস নিয়ে খোদ নাটোরের মানুষের ভিতরই ভিন্ন ভিন্ন জনশ্রুতি রয়েছে। এ মিষ্টির সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা দূরুহ ব্যাপার। শহরের এক চা দোকানের আড্ডায় নাটোরের কিছু প্রবীণ মানুষের থেকে জানা গেলো নিতান্ত দায়ে পড়েই নাকি তৈরি হয়েছিল এই মিষ্টি। নাটোর শহরের লালবাজারের মধুসূদন পালের দোকান ছিল নাটোরের প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান। সে দোকানে বেশ কয়েকটি বড় বড় মিষ্টি তৈরি চুলা ছিলো। মধুসূদন এসব চুলায় দেড় থেকে দুই মণ ছানা দিয়ে রসগোল্লা, পানতোয়া, চমচম, কালোজাম প্রভৃতি মিষ্টি তৈরি করতেন। দোকানে কাজ করতেন ১০-১৫ জন কর্মচারী। হঠাৎ একদিন মিষ্টির দোকানের কারিগর আসেনি। মধুসূদনের তো মাথায় হাত! এত ছানা এখন কী হবে? এই চিন্তায় তিনি অস্থির। নষ্টের হাত থেকে রক্ষা পেতে ছানাতে তিনি চিনির রস ঢেলে জ্বাল দিয়ে নামিয়ে রাখতে বলেন। এরপর মুখে দিয়ে দেখা যায় ওই চিনি মেশানো ছানার দারুণ স্বাদ হয়েছে। নতুন মিষ্টির নাম কী রাখা হবে- এ নিয়ে শুরু হয় চিন্তাভাবনা। যেহেতু কাঁচা ছানা সরাসরি চুলায় দিয়ে হালকা চিনির রস মিশানো হয়েছে এবং সেটাই মিষ্টি তাই তার নাম কাঁচা গোল্লা। (উল্লেখ্য রসগোল্লায় ছানা গোল করে চিনির তৈরি রসে সরাসরি ভাজা হয় এবং রসের ভিতরই রাখা হয় তাই তার নাম রসগোল্লা)।

কাঁচাগোল্লার স্বাদ রসগোল্লা, পানতোয়া, এমনকি অবাক সন্দেশকেও হার মানিয়ে দেয়। এর রয়েছে একটি মিষ্টি কাঁচা ছানার গন্ধ, যা অন্য কোনো মিষ্টিতে পাওয়া যায় না। ধীরে ধীরে মিষ্টি রসিকরা এই মিষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। তখন থেকে মধুসূদন নিয়মিতই এই মিষ্টি বানাতে থাকেন। কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কাঁচাগোল্লার চাহিদা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে মধুসূদন পালের দোকানে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন মণ ছানার কাঁচাগোল্লা তৈরি হতে লাগল। সে সময় ঢোল বাজিয়ে জানানো হতো কাঁচাগোল্লার কথা।

আর একটি গল্পও প্রচলিত আছে যে, বাংলার শাসনকর্তা রানী ভবানীর রাজত্বকালে রানী ভবানীকে নিয়মিত মিষ্টি সরবরাহ করতো লালবাজারের এক মিষ্টি বিক্রেতা। একবার সে মিষ্টি তৈরির জন্য দুই মণ ছানা কেটে রাখে। কিন্তু সকালে তাঁর প্রধান কর্মচারী দোকানে না এলে সে বিপাকে পড়ে। ছানা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় সে চিনির গরম শিরায় (রস) ছানা ঢেলে দিয়ে নাড়তে থাকে। শুকিয়ে এলে খেয়ে দেখে মন্দ হয়নি। ভয়ে ভয়ে এর কিছু অংশ রানীর কাছে পাঠিয়ে দেয়। তা খেয়ে রানী ধন্য ধন্য করে। শুধু ছানা দিয়ে তৈরি করা হয় বলে নাম রাখা হয় কাঁচাগোল্লা। যা নাটোরের মানুষের মুখে এখনো শোনা  যায়।

কাঁচাগোল্লা তৈরি প্রণালি

kacagolla-2শহরের রানী ভবানী প্রতিষ্ঠিত জয়কালী মন্দির সংলগ্ন দ্বারকানাথ কুন্ডু মিষ্টির দোকানে ১৬০ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে কাঁচাগেল্লাসহ অন্যান্য মিষ্টি তৈরি হয়ে আসছে। বড়গাছা এলাকার দ্বারিকা নাথ কুন্ডু একই সঙ্গে ছিলেন কারিগর ও দোকানের মালিক। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে ননীগোপাল কুন্ডু দোকানের হাল ধরেন। তিনি মারা গেলে বর্তমানে তার ছেলে রবীন্দ্রনাথ কুন্ডু সুনামের সঙ্গে কাঁচাগোল্লা তৈরি ও বিক্রি করছেন বলে তার সাথে কথা বলে জানা গেলো। রবীন্দ্রনাথ কুন্ডু জানান, খাঁটি দুধের ছানা ও চিনি কাঁচাগোল্লা তৈরির প্রধান উপাদান। ১ কেজি কাঁচাগোল্লা তৈরি করতে প্রায় ১ কেজি কাঁচা ছানা ও ৪০০ গ্রাম চিনির প্রয়োজন। কড়াইতে চিনিগুলো পানিসহ জ্বাল দিতে হয়। চিনি পরিষ্কার করতে সামান্য কাঁচা দুধ দিতে হয়। কড়াইয়ের গাদ ময়লা পরিষ্কার হয়ে গেলে কড়াইয়ে ছানা ঢেলে দিতে হয়। এরপর জ্বাল এবং একই সঙ্গে কাঠের খড়া (খুন্তি) দিয়ে নাড়তে হয়। এভাবেই ৩০ থেকে ৪০ মিনিট ধারাবাহিকভাবে নাড়তে নাড়তেই পরিপূর্ণ কাঁচাগোল্লা তৈরি হয়ে যাবে। তবে এই নাড়াচাড়ার মধ্যেই রয়েছে শৈল্পিক কৌশল। মোটামুটি এই হচ্ছে ১ কেজি কাঁচাগোল্লার হিসাব। আর এক কাঁচাগোল্লা তৈরির কারিগর প্রবীর সরকার বলেন, “কাঁচাগোল্লায় এলাচ, তেজপাতা ব্যবহার ব্যবহার করলে গন্ধটা ভালো হয়। তবে তারা কাঁচাগোল্লাতে এলাচ ব্যবহার করেন না। এতে প্রকৃত কাঁচা ছানার গন্ধ পাওয়া যায়।”

দেশ-বিদেশে কাঁচাগোল্লা

ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট থেকে জানা যায়, ১৭৬০ সালে অর্ধবঙ্গেশ্বরী বাংলার দানশীলা শাসনকর্তা রানী ভবানীর রাজত্বকালে কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়াতে থাকে। সেই সময় নাটোরে মিষ্টির দোকান ছিল খুবই কম। এসব দোকানে বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা ছাড়াও অবাক সন্দেশ, রাঘবশাহী, চমচম, রাজভোগ, রসমালাই, পানতোয়া, প্রভৃতি মিষ্টি ছিল অন্যতম। তবে এর মধ্যে সবার শীর্ষে উঠে আসে কাঁচাগোল্লা। ফলে সে সময় রাজা-জমিদারদের মিষ্টিমুখ করতে ব্যবহৃত হতো এই বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা। এমনকি বিলেতের রাজপরিবারেও এই কাঁচাগোল্লা যেত। আরো যেত ভারতবর্ষের সর্বত্র। রাজশাহী গেজেট পত্রিকাতেও কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতির কথা বলা হয়েছে। কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে সেই সময় কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। কলকাতা এবং নাটোর শহর একই সময় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এই দুই শহরের ঘনিষ্ঠ সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকায় ভারত, ইংল্যান্ডসহ তৎকালীন বিভিন্ন রাষ্ট্রে নাটোরের কাঁচাগোল্লার কথা ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই কাঁচাগোল্লা পায় আন্তর্জাতিকতা।

কোথায় পাবেন ভালো কাঁচাগোল্লা  

নাটোরের কিছু উল্লেখযোগ্য দোকান ছাড়া এই মিষ্টি কিনলে ঠকার সম্ভাবনা রয়েছে। লালবাজারের মধুসূদন পালের দোকান, নীচা বাজারের কুন্ডু মিষ্টান্ন ভান্ডার, অনুকূল দধি ও মিষ্টান্ন ভান্ডার, স্টেশন বাজারের নয়ন ও সকাল-সন্ধ্যা এবং মৌচাক মিষ্টান্ন ভান্ডার নামের দোকান গুলোতে ভালো মানের কাঁচাগোল্লা পাওয়া যায় বলে শহরের মানুষের কাছে জানা যায়। যা বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৩শত থেকে ৪ শত টাকার মধ্যে। তবে অনেকেই ফেরি করে বাস বা ট্রেন গাড়ির ভিতর বিভিন্ন বাজারে সস্তায় কাঁচা গোল্লা বলে বিক্রি করে সেগুলো কিনলে ঠকতে হবে।

happy wheels 2

Comments