সাম্প্রতিক পোস্ট

আমার সন্তান যেনো থাকে দুধে ভাতে

আমার সন্তান যেনো থাকে দুধে ভাতে

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়

“আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা” কিংবা “তাই তাই তাই মামার বাড়ি যাই” এই ছড়াগুলো মায়ের মুখে মুখে মুখস্ত করে বড় হয়নি এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। আবার “আতা গাছে তোতা পাখি ডালিম গাছে মৌ” এই জনপ্রিয় ছড়া প্রত্যেকটি শিশুর বাল্যকালের আনন্দ। এই ছড়ার মাধ্যমে সে নতুন পরিবেশে শেখা শুরু করে। চাঁদকে মামা ডাকতে হবে বা দুই হাতে তালি বাজিয়ে মামার বাড়ি যাওয়া যায় এই বিষয়গুলো নিয়ে সে কল্পনার জগতে হারিয়ে যায়। সে তার নতুন চোখে পৃথিবীকে আবিষ্কার করতে শুরু করে।

একটি পরিবারে যখন নতুন সদস্য আগমনের খবর আসে তখন খুশির পাশাপাশি চলে উৎসবের আমেজ। প্রতিটি জন্ম নিয়ে আসে নতুনের বারতা। একটি সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে কত মায়ের মৃৃত্যু পর্যন্ত হয়। কিন্তু জন্মের কিছুদিন (৩/৬মাস) পর যখন দেখা যায় সেই সন্তান অন্যদের মতো সুস্থ বা স্বাভাবিক নয়, তখন পরিবারে নেমে আসে অন্ধকার। সেই সন্তানকে ঘিরে দেখা স্বপ্নগুলো ম্লান হয়ে আসে। সন্তানের সুস্থতায় পরিবারের সদস্যরা ছুটে বেড়ায় এদিক, সেদিক। কিন্তু সব চেষ্টা যখন ব্যর্থ হয়ে যায় তখন ভাগ্যকে মেনে নেয়া ছাড়া নিজের মনকে সাস্ত¡না দেয়ার আর কোনো পথ খোলা থাকেনা। তারা স্বাভাবিক নয় বলে অনেক পরিবারে অনাদর আর অবহেলায় বেড়ে উঠে। এভাবেই এক সময় মৃত্যু হয়। হারিয়ে যায় একটি জীবন।

IMG_20180312_121348
আমাদের বিভিন্ন পরিবারে জন্ম নেয়া বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের কথাই বলছি। আর দশটা শিশুর মতো তারা স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারেনা। বা কোনো কোনো শিশু কানে শোনেনা, চোখে দেখেনা। আবার কথা বলা বা চলাফেরা করতে পারলেও কম বুদ্ধি সম্পন্ন হয়। শারীরিক বা মানসিকভাবে অসুস্থ শিশুরা সমাজে প্রতিবন্ধী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আমাদের সমাজ তাঁদের ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে। সেটা হতে পারে করুণার বা অবহেলার। কোনো কোনো পরিবারে তাঁদের পরিচয় গোপন রাখা হয়। অথচ এসমস্ত শিশুরা একটু আদর, পরিচর্যা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে স্বাভাবিক মানুষের চাইতেও সৃজনশীল কাজ করতে পারে। আনন্দময় পরিবেশে তাঁরা বেঁচে থাকার প্রেরণা পায়, জীবনে অগ্রসর হতে শেখে।

প্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন সকল শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে ও তাঁদের মেধাগুলোকে জাগিয়ে দিতে “সুইড বাংলাদেশ ” (SWID-Society For the Walfare of the Intellectually Disabled Bangladesh) নামক একটি সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে। সরকারি সহায়তা প্রাপ্ত সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউ-েশনের ব্যবস্থাপনায় সারা বাংলাদেশে ৪৮টি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় আছে। নেত্রকোনা শহরের মালনী রোডে অবস্থিত চন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে “সুইড বাংলাদেশ” নামক প্রতিষ্ঠানের নেত্রকোনা শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১১ সালে। এই প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ৯৪জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী আছে। তাছাড়া সেরিব্রাল পালসি (সি.পি) নামক প্রতিবন্ধী শিশুদের বাড়িতে গিয়েও বিভিন্ন বিষয় শেখানো হয়। এখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ভর্ত্তি বাবদ ফিস ৮০০ (আটশত) টাকা এবং মাসিক বেতন ২০০ (দুইশত)টাকা। নেত্রকোনা শহর ছাড়া এর আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকেও আসা শিক্ষার্থী আছে এখানে। শুক্রবার ও অন্যান্য ছুটির দিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। এই প্রতিষ্ঠানে ৬জন শিক্ষক আছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের আচরণ, অভ্যাস, ইত্যাদি বিষয়ে দশ মাসের বিশেষ কোর্স এবং ২০-২৫ দিনের বেসিক ট্রেনিং করতে হয়।

IMG_20180312_121423
এখানে পড়ালেখার চাইতে ব্যক্তিগত দৈনন্দিন অভ্যাস, আচরণ, অন্যদের সাথে মেলামেশা ও বড়দের সম্মান জানানো ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি বেশি জোড় দেওয়া হয়। অনেক শিক্ষার্থীর পড়ালেখার প্রতি কোনো আগ্রহ থাকেনা। তখন তাদের চাহিদা অনুযায়ী সাংস্কৃতিক বিভিন্ন বিষয় যেমন নাচ, গান, খেলাধূলা প্রভৃতি শেখানো হয়। এদের জন্য আলাদা কোনো পাঠ্য বই নেই। অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে ধরণের বই পড়ানো হয় এখানেও সে বই পড়ানো হয়।
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুরা আনন্দে থাকতে পছন্দ করে। তাই এখানে আছে বিভিন্ন খেলা ধূলার উপকরণ। একঘেয়েমি বা রুটিন বাধা নিয়মে তারা চলতে পারেনা। তাদের খুশিমতো সব কাজ করতে দিতে হয়। এখানকার শিক্ষকগণ অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে তাদের প্রত্যেকটি আচরণ সহ্য করেন।

এই পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে গেলে তারা আর একা থাকতে চায়না। পারিবারিক কারণ বা অসুস্থ হয়ে যদি কয়েকদিন স্কুলে আসা বন্ধ থাকে তখন বাড়িতে তারা অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে। একা একা থাকলে তারা মানসিকভাবে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে। নিজের শরীরে নিজেই আঘাত করে আবার অন্যদেরকেও আঘাত করে। একারণে প্রত্যেক অভিভাবকদের বোঝানো হয় তাদের সন্তানদের নিয়মিত এই প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসতে।

প্রতিদিন এখানে টিফিন করা বাধ্যতামূলক। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের বলে দেয়া হয় বাড়ি থেকে টিফিন দিতে। সকলের সাথে বসে কিভাবে খাবার খেতে হয়, কিভাবে হাত ধূতে হয় এ সব কিছুই এখানে শেখানো হয়। টিফিনের বাইরেও শিক্ষার্থীদের জন্য চকলেট, চিপস ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা আছে এখানে। অনেক সময় অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা প্রচণ্ড জেদ করে। তাই তাদেরকে শান্ত রাখতে কর্তৃপক্ষ এই বিশেষ ব্যবস্থা রেখেছেন।

IMG_20180312_121536
তবে সবাই যে জেদি বা পড়তে চায় না এমন নয়। এ বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় দুজন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়ে নেত্রকোনা শহরে অবস্থিত গার্লস স্কুলে ভর্ত্তি হয়েছে। এখানকার শিক্ষার্থীরা খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বেশ দক্ষ। তারা বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে এবং পুরষ্কার অর্জন করে। বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক আয়োজন ছাড়াও এখানে প্রত্যেকটি জাতীয় দিবস উদ্যাপনের আয়োজন করা হয়। এই আয়োজনে উক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই প্যারেড ও কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণ করে।

প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রতি সপ্তাহে তাদেরকে থেরাপি দিতে আসে। অসুস্থদের চিকিৎসা দেয়া হয়। অটিস্টিক শিশুদের চিকিৎসা দেয়ার সব উপকরণ এখানে আছে। প্রয়োজনমাফিক সেবা দেয়া হয়। শিক্ষকদের স্নেহময় আচরণে প্রতিবন্ধী শিশুরা বেড়ে উঠছে নিজের মতো করে। সমাজের বোঝা হয়ে নয়, নিজের যোগ্যতায় বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পাচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফুটিয়ে দুশ্চিন্তার ভার কিছুটা হলেও লাঘব করছে। প্রত্যেক মা-ই চান তার সন্তান সুস্থভাবে বেঁচে থাক, দুধে ভাতে বেঁচে থাক। এই মায়েদের আশাই পূরণ করছে সুইড বাংলাদেশ।

কৃতজ্ঞতায় :প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকগণ,
সুইড বাংলাদেশ নেত্রকোনা শাখা
নেত্রকোনা।

happy wheels 2

Comments