ঐতিহ্য হারিয়েছে বিলকুমারী

রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম শহিদ

ঐতিহ্য হারিয়েছে বিলকুমারী। রাজশাহী জেলাধীন তানোর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বিলকুমারী বিল এবার শুকিয়ে যেতে চলেছে। জীবন জীবিকার উৎস ও প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ বিলটি বিগত পঞ্চাশ বছরে এভাবে শুকিয়ে যাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়েছে কম। বর্ষার শুরু থেকেই অনাবৃষ্টির কারণে বিলে পানি জমা হয়েছে কম। মাছও পাওয়া যাচ্ছে না, বিল উপর নির্ভরশীল মানুষদের চোখে পড়েছে হতাশার ছাপ।

20170111_081901
অতীতে বিলে বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ জন্ম নিতে দেখা যেত। শাপলা, পদ্ম, শালুক, ঘেচু ভ্যাপ, শিংগাড়, লিখাড়, এছাড়াও কচুরিপানাসহ বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ দ্বারা সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে আর এসব উদ্ভিদও পাওয়া যায় না। এসব উদ্ভিদের মধ্যে লুকিয়ে থাকতো পর্যাপ্ত দেশীয় মাছ। শুধু মাছ নয় সেখানে অন্যান্য জলজ প্রাণিও পাওয়া যেত। যেমন- সাপ, কুচা, ব্যাং, কচ্ছপ ও বর্ষাকালে শুশুকও দেখা যেত। শিবনদী ও বিলের বুক চিরে চলতো লঞ্চ ও বৈচিত্র্যময় নৌকা। এলাকার মানুষ পানি পথেই মালামাল বহন করতেন বেশি। সেই ঐতিহ্য আর নেই। হারিয়েছে অনেক বৈচিত্র্যময় মাছও যেমন- পাবদা, ভেদা, গজাড়, পাতাশি মাাছ আর তেমন চোখে পড়েনা। রাস্তার উন্নয়ন ও নদীতে প্রতিবন্ধকতার ফলে বন্ধ হয়েছে পানি পথে চলাচলও।

20170111_082246
কিছু ঐতিহ্য হারালেও আজও বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক মাছের উৎস হিসেবেই পরিচিত এই বিলকুমারী। সেই মাছের বৈচিত্র্য তুলে ধরার জন্য প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে ব্যতিক্রম ধর্মী মেলার আয়োজন করা হয়। বিগত ১০ বছর ধরে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় মৎস্যজীবীরা আয়োজন করে আসছেন এই মেলা। সেখানে স্থানীয় মানুষসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলা মান্দা, নিয়ামতপুর, মহনপুর ও রাজশাহী জেলা শহর থেকে ক্রেতা মাছ কিনতে আসেন। কিন্তু মেলার দিন সামনে আসলেও এবার সেই মেলা হওয়ার অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। স্থানীয় মৎস্যজীবীরা বলছেন, ‘মাছকে কেন্দ্র করে মেলার আয়োজন হয়। সেই মাছ তো এবার বিলে নেই। তাহলে কি করে আয়োজন করবো মেলার।’
শিবনদী ও বিল পাড়ে অবস্থানরত গ্রামের মানুষের তথ্য মতে দেখা যায়, শুধুমাত্র তানোর উপজেলার (উঝলাকুড়ি-২০০, রঘুনাথপুর-২০০, মালশিরা- ২০০, বেয়ারল-৫০০, বাতাসপুর-৪০০, দমদমা- ৩০০, দমদমা মাঝিপাড়া-২০০, কামারগাঁ-২০০, গোকুল- ১০০০, কুঠিপাড়া- ৫০০, গোল্লাপাড়া-২০০, মেলান্দি- ২৫০, শীতলিপাড়া-১০০ জন জনগোষ্ঠী) প্রায় ৪২৫০ জন জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষভাবে এই বিলের মাছের উপর নির্ভরশীল।

এছাড়াও পার্শ্ববর্তী উপজেলা মহনপুর উপজেলার কিছু গ্রামের মানুষরাও এই বিলে মাছ ধরেন। শিবনদী ও বিলকুমারীতে সারাবছর পানি থাকায় মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা। উক্ত জনগোষ্ঠী এখন থেকেই বিলে তেমন মাছ সংগ্রহ করতে পারছেনা। অথচ বিলের মাছের মধ্যেই তাদের সংসারের সকল স্বপ্ন লুকিয়ে থাকে। সারাবছর মাছ ধরে গ্রামের মোড়ে ও বাজারে বিক্রি করতেন। যতটুকু রোজগার হয় তা দিয়েই চাল ডাল সংগ্রহ করেন। শুধু কি তাই ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া, পরিবারের চিকিৎসা, পোষাক, ক্ষুদ্রঋণ পরিশোধ, আত্মীয়তা, সামাজিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় উৎসব ও যোগাযোগ সব কিছুই এই বিলের মাছের সাথে জড়িত। এখন টান পড়েছে সব দিকেই।

IMG_20181125_161822
শুধু মৎস্যজীবী নয়, কৃষকদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে হতাশা। সেচের মাধ্যমে রবিশস্য চাষেও এবার টান পড়েছে। গতবারের তুলনায় বিলের পানিতে রবিশস্য চাষ হয়েছে কম। সামনে বোরো মৌসুমে পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাওয়ার আসংখ্যা করছেন কৃষকরা। পানি সংকটের আসংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে বলে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এছাড়াও প্রকৃতিক মাছ প্রত্যাশী মানুষরা বাজারে ঘুরে তাদের প্রয়োজন মত মাছ সংগ্রহ করতে পারছেনা।

তানোর উপজেলার তালন্দ বাজারের নৌকা ব্যবসায়ী মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এবারে বর্ষা কম। প্রতি বছর আমার এখানে অনেক নৌকা বিক্রি হতো। গত বছরেই আমি ৪০০ পিচ ডিঙ্গি নৌকা বিক্রি করেছি। কিন্তু এবছর বৃষ্টির পানি কম, বিলে মাছ হয়নি। তাই মাত্র ২০০টি নৌকা বিক্রি করতে পেরেছি। নৌকার চাহিদা না থাকায় অন্যান্য উপকরণ তৈরি করতে হচ্ছে। কারণ কর্মচারীদের তো বেতন দিতে হবে। তাই মুরগি হাঁসের কুঠি, চৌকি, মিটসেফ, খাট, চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি উপকরণ তৈরি করে বিভিন্ন মেলাতে বিক্রি করছি। এসব উপকরণ বিক্রির জন্য আমাকে এখন তাকিয়ে থাকতে হয় কোথায় কোথায় মেলা হচ্ছে।’

বিলপাড়ের মানুষ জানান, এবার বর্ষায় ঢলের পানি কম হওয়ার ফলে বিলে তেমনভাবে মাছের বংশ বৃদ্ধি হয়নি। বিলে পাওয়া যাচ্ছে না মাছ। বিলে মাছ না থাকলেও জীবন তো থেমে থাকেনা। জীবনের প্রয়োজনে মৎস্যজীবী পরিবারের কিছু সদস্য কাজের সন্ধানে চলে যাচ্ছেন শহরে। সেখানে তারা রাজমিস্ত্রি, গার্মেন্টস, লেদ, হোটেল, কোলষ্টোর ও রিক্সা চালনার কাজে যুক্ত হচ্ছে। অভিজ্ঞতা না থাকায় এসব কাজে সফলভাবে দক্ষতার সহিত কাজ করতেও সমস্যা হচ্ছে। ফলে কাজে টিকে থাকার মত সক্ষতা অন্যের তুলনায় কম। কিছু মানুষ ফিরেও আসছেন। এসব কাজে গুটিকয়েক যুবকরা সম্পৃক্ত হচ্ছেন। বড় অংশ থাকছেন এখনও গ্রামে। এলাকায় কৃষি কাজের বাইরে আর কোন কাজ তাদের চোখে পড়ছেনা। কিন্তু সেই কাজ জন্মের পর থেকে করতে হয়নি তাদের। কাজ করতে ভয় পাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু উপায় তো নেই, জীবিকা তো চালাতে হবে। সরকারিভাবে মৎস্য অফিসের মাধ্যমে কিছু সুবিধা আসলে তারা পেয়ে থাকেন। কিন্তু সেটা অতি সীমিত। এছাড়াও যাদের নামে কার্ড করা আছে তারাই এই সুবিধার আওতায় পড়ে। অধিকাংশই থেকে যায় এই সুবিধার বাইরে।

IMG_20181125_163813
মৎস্যজীবীরাই জানেন কিভাবে মাছ ধরতে হয়। সেই কৌশলটি পরিবারে ছোট বেলা থেকেই আয়ত্ব করে এসেছেন। কিন্তু বর্তমানে বিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে জীবিকার জন্য তাদের পেশা পরিবর্তনের ভাবনা তৈরি হয়েছে। অন্যান্য পেশায় তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে থাকাটাও তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ প্রসঙ্গে তানোর উপজেলার গোকুল গ্রামের মৎস্যজীবী আব্দুস সামাদ (৬০) বলেন, ‘আমার এ বয়সে মাছ ধরা ছাড়া অন্য কাজ করার কথা ভাবতেও পারিনা। কিন্তু পেট তো চালাতে হবে। আমার জামাই আমাকে বলে বাবা বিলে তো মাছ নেই, তাহলে আমি বাড়ি থেকে কি করবো তাই ঢাকায় চলে গেলাম। আমার বয়স হয়েছে আমি তো বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারবোনা। তাই এলাকায় কোন কাজ করে খেতে হবে।’ বিলে মাছ না থাকা ও পানি কমে যাওয়ার জন্য নিরবে রোজগারের জন্য মানুষ অন্য পেশা খোজা শুরু করেছেন। সাধারণ মানুষ এই অনাবৃষ্টি ও অসময়ে বৃষ্টিপাত সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি বলেই মনে করেন। কিন্তু বিশ্লেষকগণের উদাহরণ মতে, এটি জলবায়ু পবির্তনের প্রভাব।

শিবনদী, বিলকুমারী খনন ও সংস্কারের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, শিক্ষক, প্রবীণ ও যুবক সহ জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে শিবনদী পর্যবেক্ষণ, মানব বন্ধন, সংলাপসহ প্রশাসনে স্মারকলিপি প্রদান করে আসছেন। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বারসিক তাদের এই উদ্যোগে সহায়কের ভূমিকা পালন করে। বিএমডিএ চেয়ারম্যান, স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও বরেন্দ্র বহুমূখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিলকুমারী খনন ও সংস্কারের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সেই আলোকে বিএমডিএ চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি অষ্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক মন্ডলীসহ একটি পর্যবেক্ষক দল বিলটি পর্যবেক্ষণ করেছেন। স্থানীয় মানুষের জীবন জীবিকার উৎসটি সংস্কার করে প্রাণবৈচিত্র্য ও পেশা টিকিয়ে রাখার দাবি দীর্ঘদিনের। একই সাথে একটি পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রও রয়েছে বলে তারা মনে করেন। তাই এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের সাথে জড়িয়ে আছে হাজারো মানুষের পেশা, সংস্কৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্যের ইতিহাস।

happy wheels 2

Comments