জয়িতা পুরুষ্কারে ভূষিত হলে নেত্রকোনার হাওয়া আক্তার এবং শামছুন্নাহার
:: নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়::
নেত্রকোনারর স্বরমশিয়া ইউনিয়নের রামজীবনপুর গ্রামের হাওয়া আক্তার এবং মাটিকাটা গ্রামের শামছুন্নাহার সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে অবদান রাখার জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁদেরকে জয়িতা পুরুষ্কারে করে। সম্প্রতি উপজেলা প্রাঙ্গণে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হাত থেকে তারা জয়িতা পুরুষ্কারের ক্রেস্ট ও সনদপত্র গ্রহণ করেন। হাওয়া বেগম ও শামছুন্নাহার ছাড়াও নেত্রকোনার আরও ৩ নারী এই পুরুষ্কারে ভূষিত হয়েছে।
সাধারণত: অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী, শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী, সফল জননী, নির্যাতনের বিভিষীকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা এবং সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার ক্ষেত্রে নারীদের এই পুরুষ্কারে ভূষিত করা হয়। হাওয়া বেগম অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারীর ক্যাটগরিতে এবং শামছুন্নাহার সফল জননী নারীর ক্যাটগরিতে এই পুরুষ্কারে ভূষিত হয়েছেন।
হাওয়া আক্তার ব্যতিক্রম একজন নারী। স্বরমশিয়া ইউনিয়নের রামজীবনপুর গ্রামের বাসিন্দা। ছোটবেলা থেকেই হাওয়া আক্তার নিজের গ্রামের মানুষের বিভিন্ন কাজে সহায়তা করতেন। কারো অসুখ হলে তাকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে যেতেন। কারো বাড়িতে ঝগড়া হলে মিটিয়ে দিতেন। কোথাও কোন সমস্যা হলে সেখানে তিনি সবার আগে উপস্থিত হতেন। তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও বেসরকারি সংগঠনের কাজের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত।
২০০৬ সালে তিনি বারসিক এর সাথে যুক্ত হওয়ার পর তার গ্রামের কুটির শিল্পীদের নিয়ে “হাবাদা” নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলেন। যে সমস্ত নারীরা বাড়িতে বসে বাঁশ বেতের সাহায্যে কুটির শিল্প সামগ্রী তৈরি করেন মূলত তাদের সংগঠন এটি। বাজারে প্লাস্টিক সামগ্রির একচ্ছত্র দাপটে কুটির শিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছিল। তিনি তাদেরকে একত্রিত করে প্লাস্টিক এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। বিভিন্ন জায়গায় উন্নত কাজের প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা, সংবাদ সম্মেলন বা সেমিনারে নিজেদের অধিকার বিষয়ক সংলাপ, মান সম্মত পণ্য তৈরি করে বাজার দখল, গ্রামে ঘুরে ঘুরে পণ্য বিক্রি ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে বর্তমানে কুটির শিল্প সামগ্রী জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এই সাফল্যে পেছনে হাওয়া আক্তারের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তাঁর এই উদ্যোগে নারীরা অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে নিজের পরিবারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। তার এই উদ্যোগ ও সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি জয়িতা পুরুষ্কারে ভূষিত হয়েছেন।
অন্যদিকে শামছুন্নাহার হলেন একজন আদর্শ ও সফল মা হিসেবে পরিচিত। কৃষকের ঘরে জন্ম, এবং বিয়েও হয়েছে কৃষক পরিবারে। নিজের লেখাপড়ার দৌড় অতোটা নেই। কিন্তু নিজের না থাকলে কি হবে ? তিনি তাঁর ছেলে মেয়েদেরকে শিক্ষিত করে তুলছেন। তিনি চান তাঁর ছেলে মেয়ে যেন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েটি বড়, বর্তমানে নেত্রকোণা সরকারি কলেজে সম্মান শ্রেণিতে পড়ছে। এর পাশাপাশি স্থানীয় একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করে। এক ছেলে এইচ.এস.সি পরীক্ষার্থী, অন্য ছেলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। শামছুন্নাহার সন্তানের পড়াশোনার দেখভাল ছাড়াও সামাজিক ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত।
বারসিক এর সাথে যুক্ত হওয়ার পর তিনি নিজ গ্রামের নারীদের নিয়ে বড়দীঘি পাড়ের জৈব কৃষাণী দল নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের মূল কার্যক্রম হলো জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ। যে সব নারী এই সংগঠনের সদস্য তারা প্রত্যেকেই শামছন্নাহারের নেতৃত্বে জৈব কৃষি চর্চা করেন। কেঁচো কম্পোস্ট, কুইক কম্পোস্ট, জৈব বালাই নাশক তৈরি করে নিজের জমিতে ব্যবহার করেন এবং অন্যদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। জৈব পদ্ধতিতে সব্জী চাষ করে এই সংগঠনের নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। তাঁর এ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি এবারের জয়িতা পুরুষ্কারে ভূষিত হলেন, যা তাকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে সামনের পথে এগিয়ে যাওয়ার।