আদি পেশা এখনও টিকিয়ে রেখেছেন রবীন্দ্র নাথ ঋষী
সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল
বাংলাদেশে নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষের পারস্পারিক বসবাস। অঞ্চল, পরিবেশ এবং সক্ষমতাভেদে বেঁচে থাকার তাগিদে এসব মানুষ এক এক ধরনের পেশা বেছে নিয়েছেন। এভাবে সমাজে কেউ কৃষক, কেউ জেলে, কামার, কুমার, কেউ দর্জি, মিস্ত্রি, কেউ চাকুরিজীবী, কেউ মুচি, ঝাড়ুদার ইত্যাদি। পেশার এ বৈচিত্র্যতার কারণেই মানুষের জীবনের অনেকগুলো চাহিদা পূরণ হয়। ধানের দরকার হলে মানুষ কৃষকের কাছে যায়, কাপড়ের জন্য যায় দর্জির কাছে, মাছের জন্য যায় জেলের কাছে এবং তাদের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটানোর জন্য সমাজে বিচিত্র ধরনের পেশা তাই বিদ্যমান। সমাজের এ বৈচিত্র্যময় পেশার মধ্যে ঋষী অন্যতম। মানুষের জুতার সেলাই করা বা মেরামত অথবা রঙ করেন এ পেশার মানুষেরা। শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের ঋষী পেশার মানুষ রবীন্দ্রনাথ ঋষী। যিনি নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তার ঐতিহ্যবাহী পেশা টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
আইলা পরবর্তী সময়ে বুড়িগোয়ালিনী আশ্রয়ন প্রকল্পে বসবাসের সুযোগ পান রবীন্দ্রনাথ ঋষী। অভাবের সংসারে পড়ালেখার সুযোগ পাননি। জীবিকা অর্জনের তাগিদে ছোট্টবেলা থেকেই বাবার সাথে জুতা সেলাই এ কাজে নেমে পড়তে হয় তাকে। এভাবেই তিনি তার পিতার পেশায় যুক্ত হন এবং এখনও সেই পেশাই চালিয়ে যাচ্ছেন। বিলুতি রানীকে বিয়ে করার পর সংসারের হাল ধরার জন্য তিনি সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে সারাদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান কাজের সন্ধানে। খেয়ে না খেয়ে সারাদিন জুতা সেলাই, রঙ ও মেরামতের কাজ করেন। এ কাজে যা আয় হয় তাই দিয়ে সংসারের চাল, ডালসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ কেনেন। তবে এ পেশায় যা আয় তা দিয়ে সংসারের চলে না তার। অভাব-অনটন লেগেই থাকে। এ কাজের জন্য রবীন্দ্রনাথকে নানা রঙের কালি, চামড়া, আঠা, সুতা, পিন, পেরেক, রিপিট, পাটি, ব্রাশ, প্লাসসহ অনেক কিছু কেনা লাগে বাজার থেকে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এখন আগের মত কাজ পাইনে, তাছাড়া বাজার থেকে যেসকল জিনিসপত্র কেনা লাগে তার দাম অনেক বেড়ে গেছে। যার ফলে খরচ পাতি বাদ রেখে বেশি লাভ হয় না।” সংসার চালানোর জন্য ঐতিহ্যবাহী পেশার সাথে তিনি সাপ্তাহিক স্থানীয় বাজারগুলোতে ভ্রাম্যমান একটি দোকান দেন। গ্রামগঞ্জে কাজ খুব বেশি হয় না বলেই উপজেলার বাইরে বিভিন্ন স্থানে এক সপ্তাহের জন্য কাজের সন্ধানে যান তিনি। কারণ বাইরে সপ্তাহব্যাপী কাজ করলে ৯/১০ শত টাকা আয় হয় কিন্তু এলাকায় কাজ করলে ৫/৬ শত টাকার বেশি হয় না বলে তিনি জানান।
বসতভিটায় মৌসুমভিত্তিক নানা প্রজাতির সবজি চাষ করে সংসারের আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তাঁর স্ত্রী বিলুতি দাসী। বছরব্যাপী মৌসুমভিত্তিক বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করে সংসারে সবজির চাহিদা পূরণ করেন। বাজার থেকে সবজি কিনতে হয় না বলে সবজি কেনার টাকা সাশ্রয় হয়। এ প্রসঙ্গে বিলুতী দাসী বলেন, “স্বামীর একার আয়ে সংসার ঠিকমত চলে না। তাই আমি নিজেদের ৪ শতক জায়গাতে সবজি চাষ করি।”
পৈত্রিক পেশাকে টিকিয়ে রাখা রবীন্দ্রনাথ ঋষীর জন্য কষ্টকর হলেও তিনি চা চালিয়ে যাবেন বলে জানান। বারসিক রবীন্দ্রনাথ ঋষীর এ আগ্রহ এবং উদ্যোগকে স্বীকৃতি দিয়ে জুতা সেলাই কাজের কালি, চামড়া, আঠা, সুতা, পিন, পেরেক, রিপিট, পাটি, ব্রাশ, ব্যাগ, ও প্লাসসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সহায়তা দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঋষীর মত বাংলাদেশের নানা পেশাজীবী জনগোষ্ঠী রয়েছে। তাদের এ আদি পেশা ধরে রাখার ক্ষেত্রে সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত। তাহলেই বেঁচে থাকবে আমাদের বৈচিত্র্যময় জীবনের বৈচিত্র্যময় চাহিদা ও স্বপ্ন!