পৌষ পার্বণের পিঠাপুলি
সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল।
পিঠা বাংলাদেশ তথা বাঙালির অতি পরিচিত ঐতিহ্যবাহী একটি খাবার। বাঙালির ঐতিহ্য ও কৃষ্টির ধারা অনুযায়ী অঞ্চলভেদে পালিত হয় পৌষ পার্বণের পিঠাপুলির উৎসব। দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ভিন্নতায় পাওয়া যায় নানা ধরনের পিঠাপুলি। বাংলাদেশের যে কোন উৎসবের আনন্দে মিশে আছে রকমারি পিঠা। তবে শীতের সাথেই পিঠার সর্ম্পক একটু বেশি। খেঁজুরের রস শীতের পিঠা খাওয়ার মজাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। শীতকালের গ্রামগঞ্জে কিংবা শহরের নানা প্রান্তে দেখা যায় পিঠা পুলির উৎসব। উৎসবের আমেজে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে নানা স্বাদের পিঠা দেখা যায়। তবে বর্তমানে নানা রকম বিদেশী খাবাবের ভিড়ে নতুন প্রজন্মের নগরের অনেকেই চেনে না বা এর আসল স্বাদ পায় না। তবে সরকারি, বেসরকারি কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগে প্রাচীন এই পিঠা তৈরির ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকে টিকিয়ে রাখার জন্য নানা ঢঙে ও রঙে পালিত হয় পিঠাপুলির উৎসব। বাংলাদেশে মোটামুটি ১৫০ রকমের পিঠার প্রচলন থাকলেও সাধারণত ৩০ থেকে ৩৫ রকমের পিঠা দেখা যায়। অঞ্চলভেদে এসকল পিঠা পুলির রয়েছে বাহারী নাম।
যার মধ্যে ভাপা পিঠা, খেঁজুর রসে ভাপা পিঠা, শাহি ভাপা পিঠা, খোলা চিতুই, দুধ চিতুই, রস চিতুই বা রসের পিঠা, ডিম চিতই, সিদ্ধ কুলি পিঠা, ভাজা কুলি, ঝাল কুলি, তিলের পুলি পিঠা, ছানার পুলি, দুধপুলি, নারকেলের তিল পুলি, ক্ষীরে ভরা পাটি সাপটা, চিংড়ি মাছের নোনতা পাটিসাপটা, গাজর কপি পাটিসাপটা, তেলেভাজা পিঠা অথবা পাকান পিঠা, সুন্দরী পাকান পিঠা, গোলাপফুল পিঠা, চুসি পিঠার পায়েস, মেরা পিঠা, বিবিখানা পিঠা, কলার পিঠা, ইলিশ পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, আনারস পিঠ, কস্তুরি পিঠা, চাপাতি পিঠা, নকশি পিঠা, ফুলঝুরি পিঠা, বাদাম-নারকেল ঝালপিঠ, মুগ ডালের নকশি পিঠা, ফুলন দলা, তালের বড়া, তালের কেক, তালের পরোটা, তালের রোল কেক, তালের পায়েস, মুড়ির মোয়া, নারকেল নাড়–, নারকেলের নশকরা, তিলের নাড়–, নারকেল ও চালের নাড়–, খই এর মুড়কি, মুরালি, ছিট রুটি, কলাই রুটি, ডিমের ঝাল পোয়া পিঠা, লাল পোয়া পিঠা, মালপোয়া পিঠা, খেঁজুর রসে মালপোয়া, দই-মালপোয়া, রসবড়া, রসের ক্ষীর, কাউনের পায়েস,কাউনের পায়েস, পাটিসাপটা, নতুন গুড়ের ফিরনি, ফুল পিঠা, রাবড়ি কাটা পিঠা, আমের ঝালপিঠা, ঝিনুক পিঠা, তালের রসবড়া, তালের পাটি সাপটা, তালের রুটি, চিড়ার বরফি, চিড়ার পোলাও, চিড়ার লাচ্ছি, চিড়ার লাড্ডু, চিড়ার মালি রুটি, খেঁজুর রসে চুই পিঠা, মাংসের পিঠা, গোকুলপিঠা, শাহী টুকরা বাকেরখানি, কুশলী পিঠা, মেথি পরোটা, নতুন গুড়ের বাঁধাকপির পায়েস, দোলপিঠা, ডিম চালে ঝাল পিঠা, ফুলকপির পায়েস, লাউ ও গাজরের পায়েস, শাকপিঠালী ও চিতই, শাহী গোলাপ, সবজি পুলি, খেঁজুরের গুড়ের বরফি, খেঁজুরের গুড়ের ছানার পায়েস, উষ্ণগুজা বা ছাঁচ পিঠা, ফুলঝুরি পিঠা, খেজুর পিঠা, মুখশলা পিঠা, উটপিঠা,পোস্তদানা পিঠা, রাজাদৌলা পিঠা, পানিদৌলা, পাতা পিঠা, আন্ডা পিঠা, চুঙ্গাপিঠা, চন্দ্র পুলি পিঠা, মালাই পিঠা, গোকুল পিঠা, সূর্যমুখি পিঠা, পাপড় পিঠা, জামাই পিঠা প্রভৃতি উল্লেখ্যযোগ্য।
বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে পিঠা বানানোর প্রধান উপকরণ চালের গুড়া। বিশেষ করে হেমন্তে বাংলার ঘরে ঘরে যখন নতুন ধান ওঠে তখন সেই ধান ঢেঁকিতে ভেঙে তৈরি হয় নানা রকমের পিঠা তৈরির চাল। নতুন চালের গুড়া দিয়ে নবান্ন উৎসবে তৈরি হয় হরেক রকম পিঠা পায়েস। আর আয়েশ করে গরম গরম পিঠা পুলির স্বাদ গ্রহণ করেন ছেলে বুড়ো সকলেই। তবে শীতকালে খেঁজুরের রস দিয়ে গাঁয়ের বৌ ঝিয়েরা তৈরি করেন রঙ বেরঙয়ের নকশি পিঠা। ঘরে নতুন জামাইয়ের আগমনে পিঠার কদর বাড়ে বহুগুণ। পিঠা তৈরিতে সাধারণত নতুন ধানের চালের গুড়া, গুড়, চিনি, দুধ, আটা, ময়দা, সুজি, সেমাই, তেল, নারকেল, সবজি, ডিম, মাছ ও মাংশ প্রভৃতি উপকরণ ব্যবহৃত হয়। রকম ও স্বাদ অনুযায়ী এসকল উপকরণের পরিমাণ ব্যবহৃত হয়। অঞ্চলভেদে পিঠার বৈচিত্র্য অনুযায়ী প্রতিটি পিঠা তৈরির প্রণালীও ভিন্ন।
সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী আশ্রয়ন প্রকল্পে বসবাসরত পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর মাঝে গিয়ে দেখা যায় ঢেঁকিতে চালের গুড়া তৈরিতে ব্যস্ত লক্ষ্মী রানী, বিলুতি দাসী. রুপা বালাসহ কয়েক জন নারী। এসময় তারা জানালেন, “আমরা বাড়িতে তেলের পিঠা বানানোর জন্য চাল কুটছি, আমাদের এখানের সকলেই এই একটিমাত্র ঢেঁকি আছে, যেটাতে চাল কোটার কাজে ব্যবহার করি, এখন শীতের সময় প্রতিটি বাড়িতে পিঠা পায়েস তৈরি হয়।” এসময় শ্যামনগর উপজেলার বিভিন্ন জনসংগঠনের উদ্যোগে দেখা যায় পিঠা উৎসব প্রতিযোগিতা। যার মাধ্যমে পিঠা পুলির ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার সহায়ক ভুমিকা পালন করছে। তবে বিভিন্ন সময়ে পিঠা উৎসব প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দেশীয় ঐতিহ্যমন্ডিত এসকল পিঠা পুলির পাশাপাশি অনেক ধরনের নতুন মাত্রার সংযোজিত নাম দেখা যায়। যে কারণে দেশীয় পিঠার বিষয়টি গৌণ হয়ে যেতে পারে। ক্ষতি হতে পারে বাঙালির পিঠা সংস্কৃতির। এজন্য দেশী বা প্রবাসী সকলকে আমাদের বাঙালির পিঠা পুলির কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখার জন্য সচেতন হতে হবে। টিকিয়ে রাখতে হবে বাংলার ঐতিহ্যময় পিঠা বৈচিত্র্যকে।