রঙের শারীরিভাষায় প্রতিভাত আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, প্রকৃতি ও ইতিহাস
মানিকগঞ্জ থেকে পংকজ পাল
শিল্পীর রঙের তুলিতে কি না ফুটে উঠে! আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, ইতিহাস, প্রকৃতি-সবকিছুই ফুটে উঠে আপন মহিমায়। আমাদেরকে যেমন অতীত পানে নিয়ে যায় তেমনি ভবিষ্যত বির্নিমাণেও উৎসাহিত করে। হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, প্রকৃতিকে আবার আমাদের মনের ক্যানভাসে হাজির করে দেয়; আবেগে আপ্লুত করে আমাদেরকে। শিল্পীর রঙের তুলিতে জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষাও হাজির হয়; উদ্যমী ও প্রত্যয়ী তুলে আমাদেরকে! আত্মকেনিদ্রকতা, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা উর্ধ্বে তুলে সমাজ ও দেশের সম্মান ও গৌরব রক্ষার্থে অনুপ্রেরণার জ্বালানি দেয়; উদ্বুদ্ধ করে! এমনই একটি উদ্যোগ সম্প্রতি নেওয়া হয়েছিলো মানিকগঞ্জের তেরশ্রীতে। মানিকগঞ্জের এই তেরশ্রী অঞ্চল আবার অনেকগুলো কারণের জন্য মানিকগঞ্জবাসীর জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে এবং হয়তো থাকবে। কেননা এ অঞ্চলটি থেকেই মানিকগঞ্জবাসীরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ অভুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ অংশগ্রহণ প্রেরণা এসেছিলো। এছাড়া মানিকগঞ্জ জেলার প্রথম কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ বহু কৃতিত্বের সাক্ষী এই তেরশ্রী অঞ্চলটি। মোদ্দা কথা, শিক্ষা সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই তেরশ্রী। সৃজনশীলতার আর মানসিক উৎকর্ষতার জন্য সংস্কৃতি চর্চা প্রয়োজন। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে পরিচিত এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যেসমৃদ্ধ তেরশ্রীতে দেশের ৩৫ জন চিত্রশিল্পীর ‘রূপকল্প ঃ রঙের শারীরি ভাষা’ শীর্ষক চিত্রাংকন ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি তাই ঘটনাক্রমে নয়; বরং ঐতিহ্যের কারণেই। সঙ্গত কারণেই এ ধরনের আয়োজন তেরশ্রীতে উৎসবে পরিণত হয়।
মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার তেরশ্রীতে এ ধরনের বড় আয়োজনের নেপথ্যে ছিলেন ‘মানুষ’ পত্রিকার সম্পাদক শফিক সেলিম ও বারসিক অঞ্চলিক সমন্বয়কারী বিমল রায়। শফিক সেলিমের মতে, “তেরশ্রী ছায়া সুনিবিড়, সৌন্দর্যমন্ডিত একটি গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে পাকা রাস্তা ঢাকার সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্রাচীন জমিদার বাড়ি যদিও বিলুপ্তপ্রায়, তেরশ্রীর ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সব মিলে অন্য রকম এক পরিবেশ। হিন্দু-মুসলমান সব ধরনের লোকের বসবাস এবং প্রগতিশীল কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে তেরশ্রীতেই সম্ভব এ ধরনের আর্ট ক্যাম্প।” এই আয়োজনে শামিল হয়েছেন দেশের বরেণ্য শিল্পীবৃন্দ। তাই তো দেখা গেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনষ্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ভাস্কর শেখ সাদী ভূঁইয়া, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. শিল্পী রশিদ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক রেজাউল করিম সুমন, শিল্পী মইনুদ্দিন মনি, আর্টিস্ট শ্যামল বিশ্বাস, জয়নুল আবেদীন যেমন অংশগ্রহণ করে তাদের অভিজ্ঞতার ভান্ডার সহভাগিতা করেন তেমনিভাবে চারুকলা ইনষ্টিটিউটের প্রভাষক মো. ফরহাদ হোসেন তরফদার, দোলকের সহযোগী সম্পাদক গালিব রহমান, শিল্পী হিমু মাইন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনষ্টিটিউটের শিক্ষক ঝন্টু যোগী, কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী, কবি সরদার ফারুক, চিত্রশিল্পী ও লেখক জেমরিনা বিনতে আলী, মানুষ পত্রিকার সম্পাদক শফিক সেলিম, মানুষ পত্রিকার প্রকাশক অলক সরকার, চিত্রশিল্পী ও লোককবি হাফিজ সুফিয়া তরুণদের সাথে সহভাগিতা করেন তাদের কারিগরি দক্ষতাও!
ক্যাম্পের প্রথমদিনে ৩৫ জন চিত্রশিল্পী বিভিন্ন ধরনের ছবি আঁকেন। এভাবে দেখা যায়, মোস্তাফিজ কারিগরের আঁকা একটি ছবিতে অবলীলায় সেতার বাজাচ্ছেন একজন। পাশে বসে অধীর মনোযোগে তা শুনছেন কয়েকজন। সুরের মূর্ছনায় পুরো ঘর আন্দোলিত। এতো গেল শিল্পীর আঁকা এক প্রতিচ্ছবি। বাস্তবেও উপস্থিত দর্শনার্থীগণও সুরের মূর্ছনায় মূর্ছিত হয়েছিলেন এক চিত্রশিল্পীর বাঁশির সুরের জাদুতে। এ যেন হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালা। যতই শোনা যায় ততই ভালো লাগে; বার বার শুনতে ইচ্ছা জাগে। মূহুর্তের মধ্যেই সব জীবনের ধরনের বাধা, প্রতিকূলতা এবং দুঃখ-কষ্ট যেন উধাও! প্রতিটি শিল্পীই তাদের রঙের তুলিতে নানান ধরনের জীবনঘনিষ্ঠ চিত্র রাঙিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। দেশের অতীত, ঐতিহ্য, লোকজ সংস্কৃতি, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিয্দ্ধু, গ্রামীণ জীবন, প্রকৃতি-পরিবেশ, মানুষের প্রতিচ্ছবি কোন কিছুই বাদ পড়েনি তাঁদের তুলির আঁচড়ে!
শিল্পীদের আঁকা ছবির প্রদর্শনীতে ছিল লক্ষ্য করার মত ভীড়! প্রদর্শনীর মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় ঐতিহ্যের সাথে, লোকজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে, ভাষা আন্দোলনের সাথে, মুক্তিযুদ্ধের সাথে, দেশপ্রেমের সাথে, বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে দর্শনার্থীগণ পরিচিত হন। উপস্থিত দর্শনার্থীদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন ভাস্কর শেখ সাদী ভূইয়া ও চিত্রশিল্পী হাফিজ সুফিয়া। তিনি দর্শনার্থীদের সাথে রঙের ব্যবহার, তুলির ব্যবহার, ছবি আঁকার নানা কৌশলসহ নানাদিক নিয়ে আলোচনা করেন। এ ধরনের আয়োজন তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করছে সমাজ, সংস্কৃতি ও দেশের ঐতিহ্য রক্ষা করতে। তাই তো এমন এক ব্যতিক্রমী, চিন্তার খোরাক জাগানো আয়োজনে অংশগ্রহণ করতে পেরে অভিভূত অনার্স পড়–য়া রনি কর বলেন, “দিন দিন মানুষই কেবল আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। এই আত্মকেন্দ্রিকতা পরিবার, সমাজ তথা দেশকে ভয়াবহ অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশ দরকার। এ ধরনের আর্ট ক্যাম্প তরুণ সমাজকে সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক চর্চায় উদ্বুদ্ধ করবে।” অন্যদিকে স্কুল পড়–য়া শিক্ষার্থী লিমা আক্তার বলেন, ‘এ ধরনের ক্যাম্প আমরা কোনদিন দেখিনি, এ আয়োজন দেখে খুব ভালো লাগছে। আমাদেরও ছবি আঁকতে অনেক সহজ হবে। এটা আমাদের চারু ও কারু বিষয়ে ধারণা পেতেও সাহায্য করবে।”
কেবল তরুণ নয় শিক্ষক, অন্যান্য পেশাজীবী এবং প্রবীণদেরকেও এ ধরনের আয়োজন মুগ্ধ করেছে, অতীত সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং ইতিহাসের দিকে ফিরিয়ে এনেছে। তাই তো বীরমুক্তিযোদ্ধা লেখক ও কবি অজয় কুমার রায় বলেন, “আমাদের প্রকৃতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য, কাব্য, গান, ছবি, আমাদের আবেগের কথা, দেশপ্রেমের কথা, আমাদের গৌরবোজ্জল ইতিহাসের কথা বলেছে। এসব আমাদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিয়েছে, ভ্রাতৃত্বের মন্ত্রই প্রচার করেছে, অসাম্প্রদায়িক সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছে। দুঃখজনক হলেও আমরা উল্টো পথে হাটছি। আজ সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশে সকলের সমবেতভাবে কাজ করা একান্ত প্রয়োজন। এ ধরনের আর্ট ক্যাম্প অবশ্যই ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।” অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক প্রফুল্ল কুমার খান বলেন, “দেশীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সাহিত্য তথা এ ধরনের চর্চার বড় অভাব হয়েছে। এ ধরনের চর্চার আজ বড় প্রয়োজন, না হলে আমরা আমাদের নিজস্ব পরিচয় হারিয়ে ফেলবো। ”কবি আব্দুস সাত্তার বলেন, “হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের চিরচেনা বাঙালির সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। আমাদের মুক্তির পথ খোঁজা দরকার, আর এ জন্য প্রয়োজন এই ধরনের আয়োজন।” প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিউলী আক্তার বলেন, “আমরা বাঙালি, আমাদের নিজস্ব শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি রয়েছে। আমাদের সংস্কৃতির জন্য সারাবিশ্বে আমাদের মাথা উঁচু করার মত পরিচয় রয়েছে। বর্তমানে কিছু অপসংস্কৃতির প্রভাব পড়লেও আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। ”