মঠবাড়িয়ার কৃষক হুমায়ূন সমন্বিত কৃষিখামার
দেবদাস মজুমদার, বিশেষ প্রতিনিধি, উপকূল অঞ্চল
প্রাকৃতিক দূর্যোগ এলেই কৃষি ও কৃষকের জীবন তছনছ করে দেয়; নদীর জলোচ্ছাসে জমিতে লবণের আগ্রাসন দেখা দেয়। এতে করে ফসল মার খায়, সেই সাথে পোকামাকড়ের উপদ্রব নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। ঘূর্ণিঝড় সিডর আর আইলায় উপকূলীয় কৃষকদের ঘুরে দাঁড়াতে সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে তোলা জরুরি হয়ে পড়ে। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার বলেশ্বর নদ তীরবর্তী ছোট মাছুয়া গ্রামের কৃষক মো. হুমায়ূন কবির সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে সেই দৃষ্টান্তই স্থাপন করেছেন। কৃষিতে নিমগ্ন হুমায়ূন কবির সমন্বিত কৃষি আবাদের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হন। লোকায়ত জ্ঞান আর কঠোর পরিশ্রমে জৈবসারের ব্যবহারের মাধ্যমে চাষাবাদে সফলতা অর্জন করে তিনি। আজ এলাকায় তিনি সফল কৃষক হিসেবে পরিচিত। ইউনিয়ন পরিষদের চাকুরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়া সফল কৃষক হুমায়ূনের মতে মাছ, “গাছ, ফল আর সবজির সমন্বিত আবাদ করে যে কেউ সফল হতে পারেন।
স্থানীয়রা জানান, ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলায় বিপর্যস্ত ছোট মাছুয়া গ্রামের সফল কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমে গ্রামটি এখন আদর্শ গ্রামে পরিণত হয়েছে। এই গ্রামের কৃষক হুমায়ুন কবিরের রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও ফরমালিনমুক্ত ঘেরের মাছ, লবণ সহিষ্ণু ক্ষেতের সবজি এবং বাগানের রসালো ফল মঠবাড়িয়া, ভা-ারিয়া ও শরণখোলাসহ এ অঞ্চলের চাহিদা মেটায়। আর উৎপাদিত এ কৃষিপণ্য বাজারজাত করে কৃষিখরচ বাদে তাঁর বছরে আয় হচ্ছে প্রায় ১৫/২০ লাখ টাকা। তাঁকে অনুসরণ করে পতিত জমিতে মাছ সবজি ও ফল চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে এলাকার অনেক কৃষক ও বেকার যুবক!
মঠবাড়িয়া পৌর শহর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বলেশ্বর নদের তীরে নিভৃত ছোট মাছুয়া গ্রাম। ওই গ্রামের কৃষক মৃত ফুল মিয়া গাজীর ছেলে মো. হুমায়ুন কবির। তিনি ১৯৭৩ সালে এইচএসসি পাশ করার পর ১৯৮৩ সালে ইউনিয়ন পরিষদ সচিব পদে চাকুরিতে যোগ দেন। দীর্ঘ ২৯ বছর সফলতার সাথে মঠবাড়িয়ার তুষখালী ও ভা-ারিয়ার তেলিখালী ইউনিয়ন সচিব পদে চাকুরি শেষে ২০১১ সালে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। এরপর নিজের চাকুরি ও পেনশনের ১০ লাখ টাকা ও কুয়েত প্রবাসী ছেলের কাছ থেকে ১৩ লাখ টাকা ধার নিয়ে মোট ২৩ লাখ টাকা নিয়ে বসত বাড়িসহ আশপাশের পতিত ১২ একর জমিতে মাছের ঘের, সবজি ও ফলদ গাছ রোপণ করে গড়ে তোলেন সমন্বিত কৃষি খামার। এ কৃষি খামারের অধিকাংশ জমি পৈত্রিক হলেও বাৎসরিক বন্ধকেও কিছু জমি এ খামারের আওতায় রয়েছে। মোট ১২ একর জমির প্রায় ৭ একর জমিতে মাছ চাষের পুকুর ও সাড়ে ৩ একর জমিতে সবজি ও দেড় একর জমিতে ফলদ গাছ রয়েছে। ঘেরের বেড়ীবাঁধে সাড়িবদ্ধভাবে লাগানো হয়েছে কুল, পেঁপে, কলা আম বিভিন্ন ফলদ গাছ। পুকুর পাড়ে তৈরি করা হয়েছে ক্ষেত। এ ক্ষেতে চাষ করা হচ্ছে মৌসুমী সবজি কপি, পাতা কপি, মিষ্টি কুমড়া,সীম ও করলা।
কৃষক হুমায়ুন কবির জানান, ২০১১ সালে প্রথম এ কৃষি খামার শুরুর করার পর প্রথম দু’ বছর লাভের ফসল ঘরে ওঠেনি। তবে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে লাভজনক হয়ে ওঠে চাষাবাদ। খামার থেকে প্রতিদিন তিনি ৫ মণ মাছ, দেড় মণ কূল, ৮ মণ ওল কপি, একমণ বেগুণ, দেড় মণ সীম, একশ’ লাউ উত্তোলন করেন। মাছের খাবার, শ্রমিকের মজুরি ও অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে তিনি গড়ে প্রতিদিন ১০/১২ হাজার টাকা আয় করেন বলে জানান।
তিনি কোন ঋণ ছাড়াই নিজস্ব অর্থায়নে কৃষি প্রযুক্তি এবং নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকমুক্ত এ সমন্বিত খামারটি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালিয়ে সফল হন। তিনি বলেন, “ঘেরের পানির তলদেশে মাছের খাবারের পরিত্যক্ত অংশ ও মাছের মল মূত্রের পলি মাটি প্রতি চৈত্র, বৈশাখ ও জৈষ্ঠ মাসে সেচ দিয়ে শুকিয়ে এক থেকে দেড় ফুট পলি কাদা উঠিয়ে রোদে শুকিয়ে কম্পোস্ট সার তৈরি করি। নিজের গরুর গোবরের জৈব সার ক্ষেতে দিয়ে সবজি ক্ষেত তৈরি করি।” বলেশ্বর নদতীরবর্তী আধা কিলোমিটারের মধ্যে এ কৃষি খামারের অবস্থান হওয়ার ফলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য এলাকার বিভিন্ন বাজারের পাইকাররা নৌপথে পরিবহন সুবিধা পাচ্ছে।
এ বিষয়ে তুষখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শাহজাহান হাওলাদার বলেন, “হুমায়ূন কবির পরিবেশবান্ধব একজন সফল কৃষক। আমি কৃষক হুমায়ুনের কৃষি খামার দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ ধরণের একটি খামার গড়ার কথা ভাবছি। হুমায়ূন এলাকার সফল কৃষকের দৃষ্টান্ত।
এ ব্যাপারে মঠবাড়িয়ার ছোট মাছুয়া কৃষি ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুমন কুমার কর্মকার বলেন, “কৃষি বিভাগের পরামর্শে সম্পূর্ণ জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং কম্পোষ্ট ও জৈব সার ব্যবহার করে কৃষক হুমায়ূন সফল হয়েছেন। তিনি একজন সমন্বিত কৃষি খামারের সফল চাষী। তার উৎপাদিত মাছ ও সবজি বিষমুক্ত। কোন কৃষককে সফল হতে হলে সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে তুলতে হবে। কারণ কৃষি আসলে একটি অন্যটির পরিপূরক। কৃষক হুমায়ূন এলাকার সকল কৃষকের জন্য দৃষ্টান্ত।”