মেধা দিই, শ্রম দিই আর্তমানবতার সেবা করি বদলে দিই পৃথিবীকে
:: রাজশাহী থেকে ইসমত জেরিন ::
ছোট্ট একটা উদ্যোগ থেকে সংগঠন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ইচ্ছে’। ১২ই ফেব্রুয়ারি ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইচ্ছে’। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে কাজ করে চলেছে ইচ্ছে। প্রথমত ‘ইচ্ছে’র ইচ্ছা ছিল নিজেদের আয়ে দরিদ্র মানুষের জন্য কিছু করার। সেই ইচ্ছা থেকেই প্রথমে ফুল বিক্রির টাকা দিয়ে আশেপাশের পথশিশুদের জন্য একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাদের পথচলা। ছোট্ট একটা উদ্যোগ থেকেই সংগঠনে পরিণত হয় ‘ইচ্ছে’। আজ রাজশাহীর আদর্শ হিসেবে অন্যতম একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে পরিণত হয়েছে এই ‘ইচ্ছে’ যার অনুকরণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীরা নবজাগরণ শিক্ষা নিকেতন নামে হরিজন সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছে। আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীরা ভদ্রার পদ্মা আবাসিক এলাকায় বস্তির ছেলেমেয়েদের নিয়ে চালু করেছে ছোট্টস্বপ্ন বিদ্যালয়। ‘ইচ্ছে’র ইচ্ছে আজ অনেক শিক্ষার্থীর মনে আগামীর কর্ণধার তৈরি ও পৃথিবীকে বদলে দেবার ইচ্ছেতে পরিণত হয়েছে।
ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থীর দরিদ্র মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছে ছিল। সেই ইচ্ছে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের পথশিশুদের একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করবে। ২০১২ সালের সেই চিন্তা থেকেই তারা পহেলা ফাল্গুণের আগের দিন, পহেলা ফাল্গুণ ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস এই তিনদিন তারা ফুল বিক্রি করে। ভালোবাসা দিবসে তাদের স্লোগান ছিল “আপনার ভালোবাসা তাদেরই দিন যাদের সত্যিই আপনার ভালোবাসা ও সাহায্যের প্রয়োজন আছে”। ফুল বিক্রি করে তারা চার হাজার টাকা লাভ করে এবং ইচ্ছে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের বস্তি এলাকার ৭০জন পথশিশুদের একবেলা খাবারের আয়োজন করে। কিন্তু তারপর তাদের মনে হয় এই একবেলা খাবার খাওয়ানোর মাধ্যমে এই শিশুদের অবস্থার পরিবর্তন করা ও সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয় । তখন এমন অবহেলিত শিশুদের সাহায্যের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আরো ভালো কাজ করার ইচ্ছা জাগলো তাদের। সেই চিন্তা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের কিছু উদ্যোমী শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাত্রা শুরু করল ‘ইচ্ছে’। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারির ফাল্গুনের আগের দিন অর্থাৎ ১২তারিখে প্রথম কার্যক্রম শুরু করে বলে তাদের প্রতিষ্ঠার তারিখও হয় এই ২০১২ সালের ১২ই ফাল্গুণ।
সংগঠনের নাম ‘ইচ্ছে’ যেভাবে হলো
যখন শিক্ষার্থীরা ফুল বিক্রি করে তাদের প্রথম ইচ্ছে পুরণ করতে পারলেন তখন তাদের মনে হলো তারা একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। যেই ভাবা সেই কাজ! এভাবে প্রত্যেকেই প্রত্যেককে ইচ্ছেমতো সংগঠনের নাম দেয়ার কাজ দেওয়া হলো। নামকরণ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় তাদেরই মধ্যে একজন প্রস্তাব করলো “ইচ্ছে”। নামটি অন্যদের মনেও ধরেছে। তাই সবার সম্মতির ভিত্তিকে এই সংগঠনের নামকরণ করা হয় “ইচ্ছে”। সংগঠনের বর্তমান স্লোগান হলো ‘মেধা দিই, শ্রম দিই, আর্তমানবতার সেবা করি পৃথিবীকে বদলে দিই।’
ইচ্ছের কার্যক্রম
‘ইচ্ছে’ সংগঠনটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন মির্জাপুর বস্তির ২২জন শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের নিয়মিত পাঠদান করছে। এই শিশুরা কেউ এর আগে বিদ্যালয় নামটির সাথে পরিচিত ছিল না। এই শিক্ষাদানের সাথে জড়িত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের ঈদের সময় পোশাক দেয়া, পড়াশোনার জন্য স্কুল ড্রেস, চিত্রাংকনের জন্য রঙ পেন্সিল, বই সব কিছুই সংগঠনের পক্ষ থেকে দেয়া হয়। এছাড়াও শিশুদের নিয়ে পিকনিকের আয়োজনসহ বিভিন্ন সময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তবে পাঠদানের জন্য নিজেদের নির্দিষ্ট কক্ষ না থাকায় তারা বেছে নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের সামনে অবস্থিত গরুর খামার ঘরের বারান্দাকে। শিশুদের পাঠদান ও সহযোগিতা ছাড়া এই সংগঠনের সদস্যরা বিভিন্ন স্থান ঘুরে শীতের সময় শীতার্ত মানুষের মধ্যে শীত বস্ত্র বিতরণ করেন। গত বছরে ঝড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়কে গাছ উপড়ে পড়ায় যাতায়াতের বিঘœ ঘটলে সংগঠনের সদস্যরা রাস্তা থেকে গাছ সরানোসহ ক্যাম্পাস পরিস্কার করার কাজে স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নেয়। এছাড়াও শিশুদের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করার জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বর শহীদ মিনারে গিয়ে সম্মান প্রদর্শন এবং বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে।
শিক্ষা তহবিল সংগ্রহ
অর্থ ছাড়া আসলে কোন কাজ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। শিশুদের বই, খাতা, কলম, রঙ পেন্সিল এগুলো কেনার জন্য অর্থের প্রয়োজন। তবে সংগঠনের সদস্যদের সবার ইচ্ছে তারা তাদের নিজেদের টাকা দিয়েইএই কাজটি করবে। তাই বিভিন্ন উৎসবে যেমন পহেলা ফাল্গুণের আগের দিন, পহেলা ফাল্গুণ, ভালোবাসা দিবস, পহেলা বৈশাখ, চৈত্র সংক্রন্তি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে বেশ কিছু ফুলের দোকান দেয় তারা। সেগুলো থেকে তারা যা আয় করেন তা দিয়েই এসব শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উপকরণ কেনেন।। এছাড়া সংগঠনের সদস্যরা ২০ টাকা করে চাঁদা দেয় এবং প্রতি মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ক্যারেন্ট আ্যাফেয়ার্স বিক্রি করে টাকা আয় করে। ক্যারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বিক্রির ক্ষেত্রে একটি লাইব্রেরি তাদের সহায়তা করে থাকে। তাদের আয়ের সর্ম্পূণই বিভিন্ন সামাজিক কাজে ব্যয় করা হয়।
ইচ্ছের স্বপ্ন
ইচ্ছে সংগঠনের স্বপ্ন এই শিশুরা যতদূর পড়াশোনা করতে চায় তারা ততদূর পর্যন্ত তাদের পড়াশোনা করাবে। যেভাবে হোক তারা তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে বদ্ধপরিকর! তারা স্বপ্ন দেখে তাদের এই উদ্যোগ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে, অন্য এলাকাতেও তরুণরা এরকম উদ্যোগ নিয়ে মানবতার সেবা করবে এবং এভাবে একটি প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।
প্রবাদ আছে ‘ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়’। যখন প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি, অদম্য মনোবল ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা একত্রিত হয় তখন সমাজের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো কঠিন কিছু নয়। ‘ইচ্ছে’ সংগঠনের তরুণরা সেই প্রমাণই দিয়েছে। তরুণরা যদি যে কোন কাজে নেতৃত্ব দেয় সেই কাজ অবশ্যই সফলভাবে সম্পাদন হবেই। সেই স্বপ্ন লালন করেই ‘ইচ্ছে’র সদস্যদের ইচ্ছে পুথিবীকে বদলে দেয়া।