কৃষক মো. সাদেক বিশ্বাসের উদ্যোগ পরিবর্তন ঘটাতে পারে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি
বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে অমিত সরকার ও অমৃত সরকার
ভূমিকা
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। বর্তমান দেশে কৃষিখাত অনেক বৈচিত্র্যময় এবং গতিশীল। জলবায়ুগত সমস্যা তথা অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টিসহ নানা ধরনের সমস্যা কৃষিকে খাতকে বিপর্যস্ত করছে। কৃষি সমস্যা সমাধানে কৃষকরা প্রতিনিয়ত নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেছেন। বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ করে দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণে প্রতিনিয়তই এদেশের কৃষক অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বরেন্দ্র এলাকায় পানি সমস্যার কারণে কৃষকরা বোরো মৌসুমে পানি নির্ভর ধান চাষের পরিবর্তে লাভজনক শস্য ফসল হিসেবে ডাল ও তেল জাতীয় ফসল চাষের উদ্যোগ নিয়ে সফল হয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় এবছর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ভোলাহাট উপজেলার জামবাড়িয়া ইউনিয়নের মিরপুর গ্রামের কৃষক মো. সাদেক বিশ্বাস (৫৩) মসলা জাতীয় ফসল জিরা পাঁচ বিঘা জমিতে পরীক্ষামূলক চাষ করে সফলতা লাভের আশা করছেন।
কৃষক মো. সাদেক বিশ্বাসের জিরা চাষ পদ্ধতি
নভেম্বরের শেষে ও ডিসেম্বরের শুরুতে জিরার বীজ বপনের উত্তম সময় বলে মনে করেন কৃষক সাদেক বিশ্বাস। তিন থেকে চারটি চাষ দিয়ে মাটিতে প্রচুর পরিমাণে জৈব সার ব্যবহার করে জমি প্রস্তুত করতে হবে। বেড আকারে জমি তৈরি করে জমিতে প্রতি বিঘা ১.৫ কেজি হারে বীজ বপনের এক থেকে দুই দিনের মধ্যে একটি সেচ দিতে হবে। প্রথম সেচের সাত থেকে আট দিনের মধ্যে সকল বীজ অঙ্কুরিত হবে। ২২ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে আর একটি সেচ এবং ৫০ থেকে ৫৫ দিনের মধ্যে ৩য় সেচ প্রদান করতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে সেচ দেওয়ার সময় গাছের গোঁড়ায় যাতে পানি জমে না থাকে। বর্তমানে তার জিরার গাছে ফুল এসেছে এবং কিছু কিছু গাছে ফলও দেখা দিয়েছে। জিরার গাছ, ফুল, ফল দেখে বিঘা প্রতি (৩৩ শতাংশে এক বিঘা) ৩ মণ হারে জিরা উৎপাদন হবে বলে আশা করছেন সাদেক বিশ্বাস। একসময় এই জিরা ফসলই চাষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাবে বলে তিনি মনে করেন।
দক্ষ কৃষক তৈরিতে মো. সাদেক বিশ্বাস
দক্ষ ও অভিজ্ঞ কৃষক মো. সাদেক বিশ্বাস বৈচিত্র্যময় ফসল আবাদ করে সফল হয়েছেন। এ বছর তিনি তার এলাকায় প্রথমবারের মতো জিরার চাষ শুরু করেছেন। তার জিরা চাষের জমিটা এখন অনেক কৃষকের পরিদর্শনের স্থান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। প্রতিনিয়ত জিরার জমি দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন গ্রামের কৃষকরা। তিনি তার অভিজ্ঞতা তাদের সাথে সহভাগিতা করেন এবং কৃষির বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন কৌশল ও পথ বাতলে দেন তাদের। নিজ গ্রামের কৃষকদের পাশাপাশি গত ১৭ ফেব্রুয়ারি নাচোল উপজেলার বরেন্দা গ্রাম থেকে কৃষক আনিসুর রহমান ও তানোর উপজেলার গোকুল মথূরা গ্রামের কৃষক জীতেন্দ্রনাথ ও বারসিক প্রতিনিধিরা কৃষক সাদেক বিশ্বাসের অভিজ্ঞতা ও জিরা চাষ সম্পর্কে জানার আগ্রহে ভোলাহাটের কৃষকদের উদ্যোগ সরজমিনে পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার বিনিময় করেন। কৃষক সাদেক বিশ্বাসের জিরা ফসল ও কেঁচো সারের খামার পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে পদ্ধতিগত উৎপাদন প্রক্রিয়া ও বাজারজাত পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন নাচোল ও তানোর এলাকার কৃষক। জিরার জমি পরিদর্শন শেষে নাচোলের কৃষক আনিসুর রহমান বলেন, “মসলা জাতীয় ফসলের বর্তমান বাজারমূল্য সব থেকে বেশি। আমরা যদি আমাদের এলাকায় জিরার মত অর্থকারী ফসল চাষ করতে পারি তাহলে আমাদের এলাকার কৃষকদের জীবন মানের বড় ধরনের উন্নতি ঘটবে।” তিনি বলেন, “আমি আগামী মৌসুমে এখান থেকে জিরার বীজ সংগ্রহ করে আমার নিজের জমিতে চাষ করবো। পাশাপাশি আমি একটি কেঁচো সারের খামারও তৈরি করবো। খামার পদ্ধতিতে কেঁচো সার তৈরি করলে উৎপাদন বেশি হবে।” অন্যদিকে তানোরের কৃষক জীতেন্দ্রনাথ বলেন, “আমাদের দেশের মাটির অনেক শক্তি আছে। এই মাটিতে আমরা যাই চাষ করি না কেন সব ফসল ফলবেই। মসলা জাতীয় ফসল কৃষকদের জন্য লাভজনক ফসল। আগামী মৌসুমে এখান থেকে জিরার বীজ সংগ্রহ করে নিজ এলাকায় পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করবো।”
কৃষক মো. সাদের বিশ্বাসের কৃষিঅভিজ্ঞতা
বড় কৃষক পরিবারের মেজো ছেলে ভোলাহাটের কৃষক মো. সাদেক বিশ্বাস। ১৯৬৩ সালে ভারতের মালদা জেলার খড়িবোনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেও ১৯৬৮ সালে বাবা মায়ের হাত ধরে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় চলে আসেন। যৌথ পরিবারের সংসারে চার ভাই এবং চার বোনের বড় পরিবারে ১৯৭৮ সালে বাবার মৃত্যুর পর অর্থের অভাবে নবম শ্রেণীতেই পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে কৃষিকাজে মনোনিবেশ করেন তিনি। কৃষি কাজের পাশাপাশি মাছ চাষ, আম, কুলসহ নানা ধরনের ব্যবসার সাথেও তিনি নিজেকে জড়ান। ভারতে ঘুরতে গিয়ে এক কৃষকের বাড়িতে কেঁচো সার উৎপাদন পদ্ধতিতে অনুপ্রাণীত হয়ে তিনি নিজ বাড়িদে শুরু করেন কেঁচো খামার। এভাবে কেঁচো এবং উৎপাদিত সার বিক্রয় করে বদলে যেতে থাকে বিশ্বাস পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থান। এরই ধারাবাহিকতায় অক্টোবর ২০১৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড: নুরুল ইসলাম ১০ হাজার কেঁচো ক্রয় করেন তার খামার থেকে। এভাবে এলাকায় কেঁচো সারের ব্যাপক সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে অনেক কৃষক তার কাছ থেকে কেঁচো সার ক্রয় করতে আসেন। নিজ এলাকা ছাড়াও রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, ভোলাহাট, শিবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, তানোর, নাচোল, গোমস্তাপুরসহ নানা জেলায় মো. বিশ্বাস কেঁচো সার ও কেঁচো সরবরাহ করেছেন। এখন পর্যন্ত বিশ্বাসের হিসাব মতে, ১৪ থেকে ১৫ লক্ষ টাকার কেঁচো ও সার বিক্রয় করেছেন।
উপসংহার
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ এবং পৃথিবীর সবচে’ জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। দিনে দিনে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় কৃষকদেরকে অল্প জমিতে অধিক ফসল ফলানোর দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। আবাদী জমির উপর বেশি চাষ হচ্ছে বলে ধীরে ধীরে এর উর্বরাশক্তি কমে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে অধিক হারে রাসায়নিক সার ব্যবহার অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে। আদর্শ মাটিতে শতকরা তিন ভাগের বেশি পরিমাণে জৈব পদার্থ থাকা উচিত। কিন্তু আমাদের দেশের ৬০ ভাগ আবাদী জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ একভাগ বা তার নিচে, যা আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এক অশনি সংকেত। অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে আবাদী জমির ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তা থেকে উত্তরণের একটি উপায় হচ্ছে জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধি করা। উন্নত বিশ্বে রাসায়নিক সারের বিকল্প হিসেবে জৈব সারের ব্যবহার বহু আগে শুরু হলেও আমাদের দেশে এর ব্যবহার আশানুরূপ নয়। তবে বর্তমানে দেশের কিছু উদ্যমী কৃষকদের উদ্যোগে বাংলাদেশে জৈব কৃষির চর্চা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তেমনই একজন কৃষক ভোলাহাটের মো. সাদেক বিশ্বাস। ২০১৩ সালে কেঁচো সার উৎপাদন করে নিজ এলাকাসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক কৃষকদেরকে জৈব কৃষি চর্চায় অনুপ্রাণীত করেছেন।