“হাওরাঞ্চলে অহন মাছও নাই, পাখিও নাই”-মৎস্যজীবী আরাধন দে
সুনামগঞ্জ মধ্যনগর থেকে মাকসুদা বেগম
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে বাংলাদেশের আটটি জেলা নিয়ে হাওর এলাকা অবস্থিত। বাংলাদেশে মোট হাওরের সংখ্যা ৪২৭টি এবং দেশের মোট আয়তনের ছয় ভাগের একভাগ এলাকা নিয়ে হাওরাঞ্চল। এ এলাকাটি প্রায় ছয় মাস পানির নিচে থাকে বিধায় এই এলাকার একমাত্র ফসল বোরো ধান। ধান আর মাছ হাওর এলাকার মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। সমুদ্র সমতল থেকে হাওর এলাকার উচ্চতা ১.০০-২.৫ মিটার। হাওর সমৃদ্ধ সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর উপজেলা এখন দুর থেকে দেখলে একটি দ্বীপের মত মনে হবে।
এই মধ্যনগর দ্বীপের কাইতকান্দা গ্রামের বাসিন্দা আরাধন দে। পেশায় তিনি একজন মৎস্যজীবী। তবে বর্তমান মৎস্যজীবীদের মাছ ধরার অধিকার সঙ্কুচিত হওয়ায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। এই প্রসঙ্গে আরাধন দে বলেন, “১৫ থেকে ২০ বছর আগে শুধুমাত্র আমরাই মাছ ধরতাম। তখন মাছ ধরা এবং মাছ বিক্রি করা ছিল একটি ছোট কাজ। সবাই এই কাজকে ঘৃণার চোখে দেখতো”। তবে বর্তমানে হাওরাঞ্চলে এই চিত্রটা বদলে গেছে। আরাধন দে’র মতে, “এখন মাছ ধরার ক্ষেত্রে আর কোন জাত ভেদাভেদ নেই। সবাই মাছ মারে। এতে দোষের কিছু নাই”। সবাই নানান কায়দায় এবং বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে মাছ ধরার সাথে যুক্ত হওয়ায় হাওরাঞ্চলের মাছের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। এতে করে এলাকার মৎস্যজীবীদের জীবিকায় ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। আরাধন দে এই প্রসঙ্গে বলেন, “আগে হাওরে জাল নিয়ে গেলেই মাছ মারন যাইত। এখন হাওরে মাছ খুব কম। অনেকে কারেন্ট জাল আর খনা জাল দিয়া সব মাছ মাইরা ফালায়। খনা জালের লগে লোহার শিকল বাইন্ধা চিকড়া মাছও মাইড়া ফালায়”।
অন্যদিকে হাওরাঞ্চলে মাছ কমে যাওয়ার পেছনে কারেন্ট ও খনা জাল ছাড়াও কৃষিজমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক অনেকটা দায়ি বলে আরাধন দে মনে করেন। তিনি বলেন, “ধানের জমিতে সার এবং বিষ ব্যবহার করার ফলে মাছের রোগ হইয়া মাছ মারা যায়। আগে হাওরে বিভিন্ন ধরনের বন যেমন, ঝাউ, হাতুরি, চাইলা, হেগরা, বিন্ন, বনতুসি, পানিফল, শালুক, হুডিবন, শাপলা ইত্যাদি ধরনের বন ছিল। ফলে মাছও থাকতো বেশি। মাছ খাওয়ার লোভে অনেক দূর থাইক্কা পাখি আইত। অহন মাছও নাই, পাখিও নাই”।
আরাধন দে’র মতে, বর্তমানে হাওরাঞ্চল বিদেশি মাছে ভরে গেছে। বাজারগুলোতে দেশি মাছ দেখাই যায় না। জলাভূমি ইজারা নিয়ে প্রভাবশালীরা সেখানে বিদেশি প্রজাতির মাছ চাষ করছেন, যা দেশি মাছের বিলুপ্তিকে তরান্বিত করছে বলে তিনি মনে করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “মধ্যনগর মাছের বাজারে এখন বিদেশি মাছ সিলভার কাপ, পাঙ্গাস, ঘাসকাপ, কাইপিউ, মাগুর, তেলাপিয়া মাছে ভরা। হাওরের বাজারে দেশী মাছের বদলে বিদেশি মাছ বিক্রি হচ্ছে এর চেয়ে কষ্টের কতা (কথা) আর হইত পারে। হাওরে এখন ইজারাদারদের জন্য মাছ ধরন যায় না”। অতীতে বিলসহ অন্যান্য জলাভূমি প্রকৃত মৎস্যজীবীদের সমিতিগুলোকে ইজারা দেওয়া হতো। ফলে মৎস্যজীবীরা স্বাধীনভাবে সেখানে মাছ চাষ ও ধরতে পারতো। তবে বর্তমানে রাজনৈতিক বিবেচনায় ইজারা দেওয়া হয় বলে অমৎস্যজীবী প্রভাবশালীদের হাতে এসব বিলের মালিকানা চলে যায়, ফলে হাওরে জেলেরা মাছ ধরার অধিকার হারায়। আরাধন দে বলেন, “আগে আমাদের মৎস্য সমিতির নামে বিল ইজারা দিত। অহন রাজনৈতিক বিবেচনায় বিল ইজারা দেওয়া হয়। বিল ইজারা নিলেও পুরো হওরে কাউকেই নামতে দেওয়া হয় না। ফলে প্রকৃত মৎস্যজীবীরা দারুণ কষ্টে দিন পার করতাছে। হাওরে মাছ ধরতে হলে টাকা দিয়া সাপ্তাহিক কিস্তিতে মাছ ধরতে হয়। জালি বাইলে সপ্তাহে ৫০০-১০০০ টাকা দিতে হয়। জাল ও বরশি দিয়া মাছ ধরলে সপ্তাহে ১৫০০-২০০০ টাকা দিতে হয়ে। অনেক সময় টাকা দেওয়ার পর ইজারাদারদের লোকেরা জাল আর বরশি ধইরা নিয়ে যায়। মামলা মোকদ্দমার ভয় দেখায়। তাই ভয়ে আমরার মতো সাধারণ মানুষ মাছ ধরতে যায় না। ফলে প্রায় অধিকাংশ সময় তাদের উবশ (উপোষ) থাকতে হয়”।
হাওরে মাছ ধরার অধিকার অনেকটা হারিয়ে মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন ও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। উপরোন্তু বর্ষাকালে বন্যার পানি তাদের ঘরবাড়ি ক্ষতি করে, অবকাঠামো ধবংস করে, স্কুল শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা বন্ধ করে, গৃহপালিত পশুপাখি, আসবাবপত্রসহ অন্যান্য সম্পদ ভাসিয়ে নিয়ে যায় বলে মৎস্যজীবীদের জীবন ও বেঁচে থাকা সত্যিকার অর্থে বিপন্ন। আবার বন্যার পানি যাওয়ার ফলে নানান রোগের শিকার হচ্ছেন। এই প্রসঙ্গে আরাধন দে বলেন, “বর্ষাকালে সর্দি, জ্বর, পেটের অসুখ বেশি হয়। বাড়ির কানিত পানি আইসা পড়ে, হাওরের বড় বড় ঢেউ আইয়া বাড়ি ভেঙ্গে নিয়ে যায়। এই সময় বাচ্চারার স্কুলে যেতে সমস্যা হয়”।
এতসব বিপন্নতা ও প্রতিকূলতার মধ্যে মৎস্যজীবীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন, প্রতিদিনই নিত্যনতুন স্বপ্ন রচনা করছেন ভালো করে, পেট ভরে এবং সুখীভাবে জীবন পরিচালনার। তাই তো তারা বোরো মৌসুমে অন্যের জমিতে মজুরি দেন এবং বর্ষাকালে কোনমতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। সরকার ইচ্ছা করলে এসব মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে দরকার হাওরে স্বাধীনভাবে মাছ ধরার অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং জলাভূমিগুলো প্রকৃত মৎস্যজীবীদের কাছে লীজ প্রদান। এতে করে মানুষগুলোর জীবন-জীবিকা যেমন নিশ্চিত হবে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে তেমনি হাওরে দেশি মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজপ্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষিত ও বিলুপ্তি থেকে রক্ষা পাবে।