আধুনিক খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা জলবায়ু পরিবর্তনকে তরান্বিত করছে
সিলভানুস লামিন
খাদ্যের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি গভীর সংযোগ রয়েছে; যদিও এই সংযোগটির কথা আধুনিক খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত বিশ্বের প্রভাবশালী ব্যক্তি বা কোম্পানির কর্তারা বেমালুম ভুলে গেছেন। খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, গুদামজাতকরণ, প্যাকেটজাকরণ এবং মানুষের খাবার টেবিলে পৌছানো পর্যন্ত যত ধরনের প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয় সেসব প্রক্রিয়ায় গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসৃত হয়। একটি হিসেব মতে, খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত সব ধরনের কর্মকা- ৪৪% গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে। বর্তমান লেখাটি আধুনিক খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থার প্রতিটি ধাপে কীভাবে গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসৃত হচ্ছে এবং কীভাবে এ নিঃসৃত গ্যাস হ্রাস করা যায় তার ওপর আলোকপাত করছে।
কৃষি শস্য-ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন
সবুজ বিপ্লবের পর থেকে কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন আসে। কৃষকদের লোকায়ত জ্ঞাননির্ভর উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সেকেলে বিবেচনা করে প্রযুক্তি ও শক্তিনির্ভর উৎপাদন প্রক্রিয়ার দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করেন খাদ্য উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা। তাই তো কাঠের লাঙল, জৈব সার, মই এবং অন্যান্য লোকায়ত কৃষি উপকরণের জায়গায় স্থান পায় ট্রাক্টর, রাসায়নিক সার, কীটনাশকসহ অন্যান্য শক্তিনির্ভর যান্ত্রিক উপকরণ ও রাসায়নিক উপাদান। আধুনিক কৃষির মূলমন্ত্রই হচ্ছে বেশি উৎপাদন। বেশি উৎপাদনের জন্য কৃষিজমিতে তাই নাইট্রোজেন সার, জমিপ্রস্তুতকরণে পেট্রল, ডিজেলনির্ভর ট্রাক্টর, সেচের জন্য সেচ মেশিন, আগাছা দমনের জন্য কীটনাশক ইত্যাদি আধুনিক কৃষি উপকরণ এখন কৃষকের ঘরে ঘরে। এতবেশি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আধুনিক কৃষি তথা খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থার যাত্রা শুরু হলেও বিশ্বে এখনও মিলিয়ন মিলিয়ন ক্ষুধার্ত মানুষ রয়েছে। আধুনিক খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা প্রবর্তনের পর থেকেই ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষকরাও ক্ষুধার্ত মানুষের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। কারণ কৃষিতে তাদের চিরাচরিত অধিকার (বীজ, সার) কোম্পানির হাতে চলেগেছে; কৃষিকাজের জন্য তাদেরকে বাজারনির্ভরশীল হতে হয়েছে এবং নিজে উৎপাদনব্যবস্থার সাথে জড়িত থাকার পরও অনেকসময় তাদের অভুক্ত থাকতে হয়েছে। আধুনিক খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা কৃষি থেকে কৃষকের অধিকারকেই শুধু হরণ করেনি বরং গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন প্রক্রিয়াকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, কৃষি উৎপাদন থেকে ১১ থেকে ১৫% গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসৃত হয় বিশেষ করে আধুনিক কৃষি উৎপাদনব্যবস্থা থেকেই এই নিঃসরণ বেশি আসছে। কারণ এই কৃষিব্যবস্থায় সার-বিষ ও শক্তির ব্যবহার অনেক বেশি।
অন্যদিকে কৃষিজ শস্য-ফসল উৎপাদনের জন্য ভূমি একটি অপরিহার্য উপাদান। অথচ আধুনিক খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা যে ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন ও বন উজাড় প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুততর করেছে সে বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় থাকে না। ভূমিব্যবহার পরিবর্তন ও বন উজাড় প্রক্রিয়া জলবায়ু পরিবর্তনকে তরান্বিত করেছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় দেখানো হয়েছে। কারণ কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী জলাভূমি, পাহাড়, বন-জঙ্গল এবং অন্যান্য ভূমি কৃষি ভূমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশেষ করে কর্পোরেট খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থার প্রসার ও বিস্তার ঘটানোর জন্যই এসব ভূমিগুলোর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নিশ্চিহ্ন করে সেখানে সয়াবিন, ভুট্টা, আখ, তৈলবীজসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক খাদ্যশস্য চাষবাস শুরু হয়েছে। বিগত ১৯৯০ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এসব বাণিজ্যিক খাদ্যশস্য চাষাবাসের হার ৩৪% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এসব খাদ্যশস্যের চাষবাসের হার বৃদ্ধির সাথে সাথে ভূমির ওপর চাপ আরও বাড়ছে, বাড়ছে বনাঞ্চল উজাড়ের প্রবণতাও। অথচ উল্লেখিত এ সময়ের মধ্যে প্রধান খাদ্য খ্যাত ধান ও গমের চাষাবাসের হার নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। একটি পরিসংখ্যান মতে, বাণিজ্যিক এসব খাদ্যশস্য চাষবাস এবং মনোকালচার অনুশীলন প্রবর্তন করায় আধুনিক খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা বিশ্বের প্রায় ৭০ থেকে ৯০% বন উজাড় ও ধ্বংসের জন্য দায়ি। এর অর্থ হচ্ছে কৃষিজ শস্য-ফসল উৎপাদনের জন্য অতিরিক্ত ভূমি ব্যবহৃত ও ভূমিব্যবহার পরিবর্তন হওয়ায় এই খাত থেকে প্রতিবছর ১৫ থেকে ১৮% গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসৃত হচ্ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনকে তরান্বিত করেছে।
খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন ও প্যাকেটজাতকরণ এবং কৃষিজ আবর্জনা
আধুনিক খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থার প্রতিটি ধাপই জলবায়ু পরিবর্তনের হারকে বৃদ্ধি করছে; সেটা মাঠে ফসল ফলানো থেকে শুরু করে ভূমিব্যবহার পরিবর্তন, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতসহ মানুষের খাবার টেবিলে খাদ্য পৌছে যাওয়া পর্যন্ত। এই উৎপাদনব্যবস্থা প্রবর্তনের পর থেকে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন ও প্যাকেটজাতকরণ বৃহৎদাকারে সংঘটিত হয়েছে এবং এর প্রতিটি ধাপে গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসৃত হয়। পরিবহনের কথায় ধরা যাক, খাদ্যকে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পৌছানোর ক্ষেত্রে ডিজেল-পেট্রোল ভক্ষনকারী যানবাহন ব্যবহৃত হয়। একটি পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বে সার্বিক পরিবহন প্রক্রিয়ায় ২৫% ব্যবহৃত হয় একস্থান অন্যস্থানে খাদ্য স্থানান্তরের জন্য যাতে ৬% গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসৃত হয়। অন্যদিকে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেটজাতকরণ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণসহ অন্যান্য প্রক্রিয়ায় আরও ১০-১১% গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসৃত হয়। এছাড়া আধুনিক খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থায় উৎপাদিত সব ধরনের খাদ্যদ্রব্য ভোক্তারা কিন্তু ভোগ করার সুযোগ পায় না। কারণ এই উৎপাদনব্যবস্থায় প্রায় অর্ধেক উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যই মানুষের খাবার টেবিলে পৌছার আগেই পচে যায়। খামার থেকে ব্যবসায়ীদের কাছে যাওয়ার পথে, ব্যবসায়ীদের থেকে প্রক্রিয়াজাতকারকদের হাতে, গুদামঘরে যাওয়ার পথে এবং বাজারে যাওয়ার পথে অনেক খাদ্যদ্রব্য পচে যায়। বলা হয়, এই পরিমাণ খাদ্য যদি পচে না যায় তাহলে বিশ্বের মোট ক্ষুর্ধাত মানুষকে প্রতিদিন ছয়বার করে পেটপুড়ে খাওয়ানো যেত। প্রতিটি ধাপে পচে যাওয়া খাদ্যদ্রব্যগুলো কিন্তু খোলা আকাশে, উন্মুক্ত স্থান এবং যেখানে সেখানে পড়ে পচে নষ্ট হয়ে যায় এবং এগুলো থেকে গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসৃত হয়। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, ময়লা-আবর্জনা থেকে বছরে ৩.৫ থেকে ৪.৫% পর্যন্ত গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসৃত হয় এবং নিঃসৃত এই গ্যাসের প্রায় ৯০%ই আসে কিন্তু এই কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং পচে যাওয়া কৃষিজ আবর্জনা থেকে। উপরোক্ত আলোচনায় বেরিয়ে আসা তথ্যগুলো থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, আধুনিক খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা ও হার উভয়কে দ্রুততর করছে, মানবজাতির জন্য বয়ে আনছে নানান আপদ।
পরিবেশবান্ধব খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা অবশ্যই সম্ভব!
খাদ্য মাটিতে জন্মে এবং মাটিতেই ফিরে আসে। এটাই খাদ্যজীবনের চিরন্তন চক্র যদিও আধুনিক খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা এই চক্রকে উপেক্ষা করে আসছে। এটি মাটি থেকে প্রচুর সেবা গ্রহণ করলেও বিনিময়ে মাটিকে কোনকিছু না দিয়ে একেবারে শূন্য করে তুলেছে। বিভিন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিবেদনগুলোর মতে, চাষাবাসকৃত মাটির প্রায় ৩০ থেকে ৭০% জৈব উপাদান হারিয়েছে অর্থ্যাৎ বিগত শতাব্দীতে মাটি ১৫০ থেকে ২০০ টন জৈব পদার্থ হারিয়েছে। এসব জৈব পদার্থ কার্বনরূপে শুধুমাত্র বায়ুমন্ডলে জমা পড়েনি বরং মাটি ক্ষয়ের মাধ্যমে এগুলো নদী ও সমুদ্রগর্ভেও জমা পড়েছে। অন্যকথায় বলা যায়, বায়ুমন্ডলে যে অতিরিক্ত ২৫ থেকে ৪০% কার্বন রয়েছে সেগুলো আসলে মাটির ক্ষয়রোধ এবং জৈব পদার্থ হারানোর কারণে হয়েছে। তবে আশার কথা হলো, যে পরিমাণ জৈব পদার্থ মাটি হারিয়েছে সেগুলো পুনরায় প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। আধুনিক কৃষি আসার আগে বিশ্বের কোটি কোটি কৃষক তাদের লোকায়ত জ্ঞানের মাধ্যমে বংশপরম্পরায় এই অনুশীলনটিই করে আসছেন। এক্ষেত্রে দরকার উৎপাদনব্যবস্থায় খাদ্যশস্যবৈচিত্র্য আনায়ন, খাদ্যশস্য উৎপাদন ও প্রাণীজ সম্পদের মধ্যকার সমন্বয়, বৃক্ষ ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক গাছ-গাছড়ার লালনপালন ও সংরক্ষণ। উৎপাদনব্যবস্থার বৈচিত্র্যকরণ এবং রাসায়নিক পদার্থ ও যন্ত্রনির্ভর উৎপাদনব্যবস্থা বাতিলকরণের মাধ্যমে মাটির উৎপাদন ক্ষমতার সম্ভাবনা বাড়বে, মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে এর উর্বরতা বৃদ্ধি পাবে এবং মাটির পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। যার অর্থ হলো অতিরিক্ত বৃষ্টি সংঘটনের হার কমবে, কমবে বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটনের ঘটনাও। অন্যদিকে মাটির জেনেটিক কার্যাবলী বৃদ্ধি পেলে উদ্ভিদসহ অন্যান্য কৃষিজ শস্য-ফসলের ওপর পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণের হার কমবে। এই প্রক্রিয়াটি সম্পাদনের জন্য সারাবিশ্বের ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষকদেরকে সাথে রাখতে হবে, তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং একই সাথে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে যাতে তারা পরিবেশবান্ধব বৈচিত্র্যময় খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা চর্চা করতে পারে। ভূমি থেকে তাদের অধিকার খর্ব না করে এবং খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা থেকে তাদের সম্পৃক্ততাকে কাটছাট না করেই এ কাজটি করতে হবে।