ঔষধ শিল্পে ভেষজ উদ্ভিদের চাহিদা
মানিকগঞ্জ থেকে এম আর লিটন
বলা হয় বৃক্ষ মানুষের পরম বন্ধু। মানুষের প্রাণ বাঁচায়। জানা যায়, প্রতি মিনিটে বিশ্বে প্রায় ১২০০ কোটি মেট্রিক টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হচ্ছে। যা প্রাণীজগত বা মানুষের জন্য হুমকি। আর এই কার্বন ডাই অক্সাইড বৃক্ষ গ্রহণ করে মানুষ সহ অন্য প্রাণীদের জন্য দিচ্ছে অক্সিজেন।
কানাডার জাতীয় পরিবেশ এজেন্সি একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ‘গড়পড়তা দুটি পরিপূর্ণ বৃক্ষ যে অক্সিজেন সরবরাহ করে; তা চার সদস্যের একটি পরিবারের জন্য যথেষ্ট’। একটি দেশের মূল ভূখণ্ডের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন, বাংলাদেশে রয়েছে মাত্র ১০ ভাগ। গ্রামীণ বনায়ন রয়েছে মাত্র ৭ ভাগ। ফলে দেশের পরিস্থিতি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।
দেশের উদ্ভিদগুলোকে মোটামুটি ৩টি ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ ফলজ, বনজ ও ঔষধি। এর মধ্যে ঔষধি গাছ অন্যতম ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় পাঁচ হাজার উদ্ভিদ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সাড়ে পাঁচশ ঔষধি প্রজাতি বা ভেষজ। কিন্তু দেশের অঞ্চল বা জেলা থেকে বিগত অনেক প্রজাতির ঔষধি গাছ ও লতা গুল্ম হারিয়ে যাচ্ছে।
এমন ভায়বহ পরিস্থিতি চলতে থাকলে অবশিষ্ট ঔষধি গাছগুলো সমূলে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যার ফলে গুরুত্ব সহকারে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, ‘ফলজ ও বনজ বৃক্ষের সঙ্গে ঔষধি গাছ লাগান’, ‘গাছ লাগান, গাছের পরিচর্যা করুন’।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল বা জেলায় একসময় দেখা যেত অর্জুন, বহেরা, হরতকি, পিপুল, সর্প গন্ধা, চান্দার, বানরলাঠি, লজ্জাবতি, আমলকি, ফুলগরি, দেশি নিম, তমালগাছ, যকৃত, ইছুবগুল, তোকমা, অশোক, তেজবল, শতমূল, কদবেল, গোক্ষরকাটা, ভূই কুমড়া, সোনাপাতা, বাখালশসা, যজ্ঞ তুমুরা, মৌভাল, একাঙ্গি, আনুই গোটা, যষঠি মধু, বচ, সিটকি, চাল মুগড়া, কালো মেঘ, তেলাকোচ, ছাতিম, তুলশি, বাসক, গন্ধভাদালী, দুবলা, থানকনি ও হাতির শুঁড়সহ অসংখ্য ঔষধি গাছ ও লতা গুল্ম। তবে পরিচর্যা ও সংরক্ষণের অভাবে এগুলো আজ বিভিন্ন অঞ্চলে এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেকগুলো বিলুপ্ত হয়েছে আবার কিছু কিছু উদ্ভিদ রয়েছে যা বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।
কিন্তু এই ঔষধি গাছ সেবন বা ব্যবহারে বিভিন্ন রোগ ও অসুখ থেকে মুক্তি দেয়। এই ওষুধি উদ্ভিদের উপকারিতা ব্যাপক যেমনঃ সর্দি-কাশি, পেটের পীড়া, কফজনিত বুকের ব্যথা, খোস-পাঁচড়া, পাতলা পায়খানা, পেটে কৃমি, দাঁতের রোগ, রক্তহীনতা, অর্শ রোগ, চোখের রোগ, পিত্তবেদনা, গলার স্বর বসে যাওয়া, হৃদরোগ, বদহজম, আমাশয়, হাঁপানি, ঢেঁকুর ওঠা, পেটফাপা, বাত রোগ, মূত্রনালির অসুখ, শ্বাসনালী ঘটিত রোগ, প্রসাবে জ্বালা পোড়া, রক্তচাপ, ঘনঘন পানি তৃষ্ণা, বমি-বমি ভাব, অন্ত্রের খিঁচুনি, কোষ্ঠকাঠিন্য সহ বিভিন্ন রোগ ও অসুখে ঔষধ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভেষজ চিকিৎসার স্বীকৃতি দিয়েছে। উন্নয়ন ধারার এক তথ্যে বলা হয়, জার্মানির মতো উন্নত দেশে ভেষজ ঔষধ উৎপাদন, উন্নয়ন ও ব্যবহার হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে বছরে এক দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ভেষজ ঔষধ ব্যবহার হয়ে থাকে। বিশ্বে ভেষজের বিশাল বাজার রয়েছে। বর্তমান চাহিদার পরিমাণ প্রায় ৬ হাজার কোটি ডলার। চীন প্রধান ভেষজ উধিদ রপ্তানিকারক দেশ। চীন বাংলাদেশী মুদ্রায় বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা মূল্যের ভেষজ উদ্ভিদ রপ্তানি করে থাকে। এ ছাড়াও থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ঘানা, পাকিস্থান, তানজানিয়া, ইরান ও শ্রীলংকা অন্যতম ভেষজ রপ্তানিকারক দেশ।
ঔষধি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ভেষজ উদ্ভিদের চাহিদা সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশে ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ইউনানি, আয়ুর্বেদ ও হোমিওপ্যাথি ঔষধ উৎপাদনে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি বিউটি পার্লার ও প্রসাধনীতে এখন প্রচুর ভেষজ উৎপাদন ব্যবহৃত হচ্ছে। এমন অবস্থায় দেশের প্রতিটি মানুষের কর্তব্য ও দায়িত্ব হচ্ছে ভেষজ উদ্ভিদ বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা। ফলজ ও বনজ উদ্ভিদের পাশাপাশি ভেষজ বা ঔষধি উদ্ভিদ রোপণ করা এবং পরিচর্যা করা।
লেখকঃ প্রকাশনা সম্পাদক, তারুণ্যের আলো, মানিকগঞ্জ এবং ছাত্র, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ২য় বর্ষ, খান বাহদুর আওলাদ হোসেন খান কলেজ।