নিজের অধিকার আদায়ের জন্য বনজীবী নারীরা গড়ে তুললেন সংগঠন
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে জেসমিন আরা ও বিশ্বজিৎ মন্ডল
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকুলীয় এলাকার সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ৯ নং বুড়িগোয়ালীনী ইউনিয়নের একটি গ্রাম দাঁতিনাখালী। গ্রামটির আয়তন ৩ কিলোমিটার। গ্রামটিতে প্রায় ৭০০০ লোকসংখ্যা বাস করে যার মধ্যে প্রায় ৫০০০ জনই বনজীবী। তারা বন বিভাগের নিয়মকানুন মেনে সুন্দরবনের কাঠবর্হিভূত বনজ সম্পদ সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ১৯৮০ দশকের পূর্বে সুন্দরবন সংলগ্ন এ গ্রামটিতে বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি ছিল। বনজীবী পুরুষেরা সুন্দরবন থেকে বনজ সম্পদ সংগ্রহ করতো এবং নারীরা বাড়ির পাশে কৃষিজমি থাকায় গবাদিপশু পালন, ধান ও বসতভিটায় সবজি চাষ করতো। পরিবার দেখাশুনার পাশাপাশি ওই সব আয়বর্ধক কাজ করে বনজীবী নারীদের অবদান ছিল পুরুষের প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু ১৯৮০ দশকে এ অঞ্চলে কৃষি জমিতে লবণ পানি তুলে চিংড়ি চাষ শুরু হওয়ার পর থেকে বনজীবী নারীরা কর্মহীন হয়ে পড়েন। অন্য কোন উপায় না দেখে বনজীবী নারী শেফালি, সাজিদা, সোনাভানু, সেলিনা এবং আশেপাশের কয়েকজন নারীদের নিয়ে গড়ে তুলেন “দাঁতিনাখালী বনজীবী নারী উন্নয়ন সংগঠন” । এভাবে শুরু হয় বনজীবী নারী সংগঠনের পথচলা। সংগঠনের মোট সদস্য ৪২ জন। বনজীবী নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সুন্দরবন থেকে সংগৃহীত বনজ সম্পদ দ্বারা পণ্য তৈরি করে বাজারজাতকরণের মাধ্যমে পুরুষের পাশাপাশি পরিবারের আয়বর্ধনমূলক কর্মকান্ডে নারীদের যুক্ত করাই ছিল সংগঠন প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য। সংগঠন তৈরির পর থেকে নারী নানান কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন সভা, আলোচনা ও প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহণ করে নিজেদের যেমন দক্ষ করে তুলেন ঠিক তেমনি তাদের জীবন ও জীবিকার বিভিন্ন বিষয়গুলো অন্যদেরকে জানান। এভাবে অন্যদের মানুষের সাথে, সংগঠনের সাথে তাদের সম্পর্ক ও আদান-প্রদান তৈরি হয়। বিভিন্ন সংগঠনের সাথে বনজীবী নারীদের সম্পৃক্ততা সদস্যদের মতাতম প্রকাশে, এলাকার সমস্যা চিহ্নিতকরণে, অধিকার সচেতনতা ও আত্মকর্মসংস্থান তৈরির সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। শুধু তাই নয় সামাজিক উন্নয়নে শিক্ষার বিকাশ, নারী মুক্তি ও নারীর ক্ষমতায়নে সংগঠনটি ভূমিকা রেখেছে। এই ধারাবাহিকতায় নিজেদের মধ্যে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে সংগঠনের মাধ্যমে একজন বনজীবী নারী (সংগঠনের সভানেত্রী) ২০১১ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হন ইউপি সদস্য হিসেবে। সংগঠনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় বনজীবী হিসেবে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরেন বনজীবীরা। বাদাবন পণ্য (মধু পরিশুদ্ধকরণ ও বোতলজাতকরণ, আচার তৈরি) তৈরী, বিভিন্ন হস্তশিল্পের পণ্য তৈরি ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে এলাকায় পরিচিতি লাভ করতে থাকে।
সংগঠনটি বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করলেও সংগঠনের নিজস্ব কোন কার্যালয় ছিল না। এর ফলে বেশ সমস্যায় পড়তে হয় সংগঠনের সদস্যদের। এছাড়া নিজস্ব কোন কার্যালয় না থাকায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রদত্ত বিভিন্ন সেবা, সুযোগ-সুবিধা থেকে বনজীবী নারীরা বঞ্চিত হতো। সংগঠনের সদস্যরা তাই সিদ্ধান্ত নেন একটি কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করার। বারসিক’র কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে তারা একটি কার্যালয় তৈরি করে। এরপর থেকে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। সরকারি ও বেসরকারি সেবা ও সুযোগ-সুবিধাগুলো এই বনজীবী সংগঠনের মাধ্যমে বনজীবী নারীদের হাতে চলে আসে। বিগত দিনে সংগঠনটি বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (রিলিফ ইন্টারন্যাশনাল, সুশীলন, কারিতাস, সিসিডিবি, ক্যারেল, টাইগার টিম ও ইউনিয়ন পরিষদ) সেবা আদায়ের মাধ্যমে নিজেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ পর্যন্ত সেলাই মেশিন, মুদি দোকান, ছিট কাপড়, পা ভ্যান, ভেড়া, ছাগল, কাঁকড়া চাষ, পানির ট্যাংক, রাজহাঁস, বন্ধু চুলা, নৌকা সহযোগিতা পেয়েছেন বনজীবী নারীরা। এই বনজীবী নারী সংগঠনের হস্তক্ষেপেই এটি সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা (শিশু কার্ড, বয়স্ক ভাতা কার্ড, ৪০ দিনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ) আদায়ে সদস্যদের সহায়তা করেছে সংগঠনটি।
কিভাবে এ সহযোগিতা পেয়েছেন জানতে চাইলে বনজীবী নারীরা বলেন, “আগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা আমাদের গ্রামে গ্রামে ঘুরে লোক মুখে শুনে নামের তালিকা তৈরি করতো। সংগঠনের ঘর হওয়াতে তারা এখানে বসে আলোচনা করে এবং কোন সময় কি কাজ করবে সে বিষয়ে পরামর্শ নেয় সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে।” তারা বলেন, “এ সহযোগিতায় আমাদের পরিবারের আয়ের একটি পথ তৈরি হয়েছে।” এই প্রসঙ্গে সহযোগিতা প্রাপ্ত নারী তানিয়া বেগম বলেন, “আমি দর্জির কাজ জানতাম। কিন্তু মেশিন ও শিট কাপড় কেনার অর্থ না থাকায় বাড়িতে ছেলে মেয়ের দেখাশুনা ছাড়া আর কোন কাজ করতাম না। কিন্তু সংগঠনের সহযোগিতায় আমি মেশিন পেলাম। ফলে আমার আয়ের পথ তৈরি হলো”। বনজীবী নারী শারমিন, তানিয়া, শেফালি, মুন্না, ছাবিনা, শিলা, মাজেদা ও সেলিনারা বলেন,“বনজীবী নারী হওয়াতে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলাম। কিন্তু সংগঠন তৈরির মাধ্যমে বনজীবী নারীরা একত্রিত হয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হয়েছি”।
নারীর ক্ষমতায়নে অবহেলিত বনজীবী নারীরা সংগঠিত হয়ে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি পরিবারের আয় বর্ধনমূলক কাজের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে। বর্তমানে পারিবারিক যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের মতামতকে মূল্যায়ন ও সম্মান করা হয়। কাজের এক পর্যায়ে সংগঠনের সদস্যরা অনুভব করে যে সংগঠনটির সরকারি নিবন্ধন প্রয়োজন। নিবন্ধন এর জন্য আলোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ তৈরিতে বারসিক এর সহযোগিতা চান। বারসিক’র কারিগরি সহযোগিতায় জাতীয় মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাধ্যমে মার্চ ২০১৬ তারিখ সংগঠনটি নিবন্ধন লাভ করে।
সংগঠন একটি সম্মিলিত শক্তির রূপ। সংগঠিত হয়ে বনজীবী নারীরা গ্রামীন উন্নয়নমূলক কাজের সাথে সম্পৃক্ত। নদীর চর বনায়ন, ভেড়ী বাঁধ সুরক্ষায় সচেতনতা, বাল্য বিবাহ রোধ, গর্ভবর্তী মায়ের পুষ্টি নিশ্চিতকরণ, সুপেয় পানি ব্যবস্থাপনা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা জানা এবং তা প্রাপ্তিতে সহায়তা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে এই সংগঠন ভূমিকা রেখে চলেছে। উপকূলীয় বনজীবী নারীদের এ উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও তা স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে অনেক নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায়, সাবলম্বী হতে ও উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরিতে সহায়ক হতে পারে বলে আমরা মনে করি।