বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিন
মানিকগঞ্জ থেকে এম.আর লিটন
বাংলাদেশ একটি নদী মাতৃকদেশ। দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের অন্যতম বাহক নদ-নদী। সেই সাথে নদীর নিভৃতে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ‘‘শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ৮০০ নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪,১৪০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে”। রাইজিং বিডি.ডট কম এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘‘গত এক হাজার বছরে বিলীন হয়ে গেছে এদেশের দেড় হাজার নদী। এখন জীবিত আছে মাত্র ২৩০টি নদী।” বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এর হিসাব অনুযায়ী, ‘‘বাংলাদেশের নদীর সংখ্যা এখন ৪০৫টি। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী ১০২টি, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদী ১১৫টি, উত্তর পূর্বাঞ্চলের নদী ৮৭টি, উত্তর কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী ৬১টি, পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলে ১৬টি এএবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নদী ২৪টি হিসেবে বিভাজন করে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।’’
কিন্তু নদ-নদীগুলো বর্তমানে দখল-দূষণে মৃত প্রায়! এই নদ-নদীগুলো বিভিন্নভাবে হত্যা করা হচ্ছে। ফলে নদীকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে এবং বিলুপ্তির পথে প্রাকৃতিক পরিবেশের অন্যতম সম্পদ নদ-নদী। গত ১৫ মার্চ, ২০১৬ দেশের পাঁচটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার (দৈনিক সংবাদ, Daily Star, ইনকিলাব, ইত্তেফাক এবং দৈনিক যুগান্তর) প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এ দেশে নদ-নদীর নাজুক অবস্থার চিত্র ফুটে উঠে। বেশি নয়; একদিনের প্রকাশিত পাঁচটি গণমাধ্যমে (সংবাদপত্র) নদ-নদী সংক্রান্ত সংবাদগুলো আমাদের অবাক করে যে, বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো কত অসহায় এবং কতটা দূর্দশার মধ্যে যাচ্ছে!
দৈনিক সংবাদের সম্পদকীয়তে দেখা যায় যে, ‘‘রাজধানীর চার দিকের নদ-নদীগুলোতে ৫ বছর ধরে গভীর খনন বন্ধ আছে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে যে, গত ৫ বছরে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, তুরাগ ও বালু নদে ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করা হয়নি। ফলে এসব নদ-নদীর তলদেশ খনন এবং বর্জ্য অপসারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। দু’টি নদীতে এক্সক্যাভেটর মেশিন দিয়ে শুধু তীরের খনন কাজ করা হচ্ছে। প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, রাজধানীর চারপাশের নদ-নদীগুলো ১১০ কিলোমিটার অংশ থেকে বর্জ্য অপসারণের লক্ষ্যে একটি মহাপ্রকল্প নেওয়া হয়। কিন্তু ২২ কোটি টাকার সেই মহাপ্রকল্প এখন পর্যন্ত একনেক সভায় যায়নি।”
রাজধানীর চারপাশের নদীগুলো দখল দূষণে আজ মৃতপ্রায়। ট্যানারি বর্জ্য, শিল্প কলকারখানার বর্জ্য, হাসপাতালের বর্জ্য, গৃহস্থালিত বর্জ্যসহ নানা ধরনের বর্জ্য এসব নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। নিয়মিত বর্জ্য অপসারণ করা না হলে এসব নদ-নদীর অবশিষ্টাংশও রক্ষা করা যাবে না। কিন্তু গত ৫ বছর ধরে ড্রেজিং মেশিন ব্যবহার করা হয়নি। আবার এই সময়ের মধ্যে নদ-নদীতে বর্জ্য ফেলাও বন্ধ করা হয়নি। তলদেশ খনন আর বর্জ্য অপসারণের কাজ করা দরকার নিয়মিত। অথচ সে কাজটি বছরের পর বছর ধরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ করছে না। আর এজন্য কেউ তাদের জবাবদিহি আদায় করছে বলেও জানা যায় না। রাজধানীর চারপাশের নদ-নদী রক্ষার কাজে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ অবহেলার কারণ কী সেটাও জানা যায়নি।
Daily Star এ প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, সিলেটের জাফলং এর পাইন নদীতে বেআইনিভাবে নির্মিত কাঠের সেতু নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। পাথর ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসাকে চাঙ্গা করার জন্য নদীর পাথর সহজে উত্তোলন ও সরবরাহ করার জন্য এ কাঠের সেতু নির্মাণ করেছেন। এ কাঠের সেতুর মাধ্যমে ট্রাকগুলো নদীর ওইপারে গিয়ে সহজে পাথর বহন করতে পারে। কিন্তু কাঠের সেতুটির কারণে এ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ যে বিঘিœত হয়েছে সেদিকে কারও নজর নেই! অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলনের কারণে নদীটির স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক সৌদর্য্য বিনষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত হয়েছে, “হোসিয়ারি পাট শিল্পসহ নারায়ণগঞ্জকে প্রাচ্যের ডান্ডি হিসেবে পরিচিতি করার জন্য শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্বিচারে নির্যাতন শুরু হয়েছে। এতে করে এ নদীর গৌরবোজ্জল ইতিহাস আজ বিলুপ্ত হওয়ার পথে। বর্তমানে মানুষ এ নদীর পাশ দিয়ে হাটাচলা করলে নাকে রুমাল বেঁধে রাখতে হয়। এর স্বচ্ছ পানি এখন কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত। এ অবস্থায় ওয়াসার সরবরাহকৃত নামেমাত্র শোধন করা এ পানি পান করে নগরবাসী আক্রান্ত হচ্ছে নানা ধরনের রোগে। এরপরও বিভিন্ন শিল্প ও ডাইং কারখানার ক্যামিকেল মিশ্রিত হচ্ছে শীতলক্ষ্যা নদী পানিতে। হাইকোর্ট নদীর এ করুণ দশার সংস্কারে জন্য নির্দেশ দিলেও দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না।’
এছাড়া দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “ধলেশ্বরী নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করার ফলে হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে সিংগাইর-তালেবপুর সড়ক সেতু। অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকার বালু বিক্রি করলেও সরকার হারাচ্ছে এখান থেকে মোটা অংকের রাজস্ব। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বালু উত্তোলন হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে সেতুর কাছে বালু উত্তোলনের ফলে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে ধলেশ্বরী নদীর উপর তালেবপুরের ইসলামনগর নামক স্থানে নির্মিত এ সেতুটি। অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে নদী হারাচ্ছে গতিপথ। দেখা দিয়েছে ভাঙন।’’ একইভাবে দৈনিক যুগান্তরেও প্রকাশিত হয়েছে, “সুন্দরবনের পশুর নদী শিল্পদূষণের কবল থেকে রক্ষাসহ মংলা ঘষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌরুট সচল রাখার দাবিতে নৌ-বন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। কীর্তনখোলা নদীসহ সবনদী ও খালের অবৈধ দখল এবং দূষণ প্রতিরোধ বাস্তবায়নের দাবিতে নৌ-বন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে।”
একদিনে ৫টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নদী বিষয়ক এসব সংবাদ এই সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনে সীমাবদ্ধ নয়; এগুলো উদাহরণ মাত্র! প্রকাশিত এসব সংবাদে মাত্র কয়েকটি নদীর করুণ অবস্থার কথা জানা যায়। বাস্তবে বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি নদীই আজ বিপন্ন! দখল, দূষণ, ভরাটসহ নানান অপরিকল্পিত উন্নয়ন উদ্যোগের কারণে এসব নদী তাদের ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে, কমে গেছে এসব নদীর নাব্যতা! বর্তমানে প্রতিদিনের ইলেক্ট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ায় চোখ বুলালেই এসব নদীর করুণ আর্তি শোনা যায়। এসব গণমাধ্যমে প্রতিদিনই নদী হত্যা, নদী দখল, নদী দূষণ, নদী ভাঙন ও নদী ভরাট ইত্যাদি জাতীয় সংবাদ প্রকাশ করছে; যদিও যথাযথ কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে নিরব দর্শক ও শ্রোতার ভূমিকা পালন করছেন। বস্তুত এসব সংবাদগুলো একটি বার্তাই দিয়েছে যে, বাংলাদেশের নদ-নদীর অবস্থা এখন খুবই করুণ! এ সব নদ-নদীকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ এ সব নদ-নদী বিলীন হলে, বিলুপ্ত হলে এদেশের মানুষের জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি যেমন বিপন্ন হবে ঠিক তেমনি স্থরিব হবে সব ধরনের উন্নয়ন উদ্যোগ।
এমন অবস্থায় সরকারসহ দেশের প্রতিটি নাগরিককে নদ-নদী রক্ষায় সচেতন ও আন্তরিক হতে হবে। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বাঁচাতে এবং দেশের পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় নদ-নদী দখল ও দূষণমূক্ত করার কোন বিকল্প নেই!