টমেটো সংরক্ষণের প্রাকৃতিক উপায়
সাতক্ষীরা, শ্যামনগর থেকে জেসমিন আরা, বিশ্বজিৎ মন্ডল ও রামকৃষ্ণ জোয়ারদার
কোন ধরনের ফ্রিজ ছাড়াই টমেটো সংরক্ষণ করার চেষ্টা করছেন উপকূলীয় সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের ধানখালী গ্রামের কৃষাণী বীথিকা রানী (৩৬)। বছর খানেক আগেও টমেটো সংরক্ষণের এ পদ্ধতি সম্পর্কে তার ধারণা ছিল না বললেই চলে। বিষয়টি সম্পর্কে তিনি জেনেছেন বাড়ির পাশে ভাড়া থাকা একটি পরিবারের নিকট থেকে। একদিন গল্প সূত্রে তিনি টমেটো সংরক্ষণের এই পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের নিকট থেকে জানতে পারেন। তবে সব ধরনের টমেটো এ পদ্ধতিতে বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায় না বলে তিনি জানিয়েছেন। এক্ষেত্রে বিশেষ এক ধরনের টমেটোর জাতের কথা তিনি উল্লেখ করেন। আপেল টমেটো নামে যে পরিচিত টমেটোর জাতটি আমাদের দেশে চাষ হয় সেটি এ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা সুবিধাজনক। কারণ এ টমেটো আঁশে পুরু ও শক্ত এবং কম রসালো। বেশি রসযুক্ত এবং পাতলা ও নরম আঁশের টমেটো হলে তা বেশিদিন সংরক্ষণ উপযোগী করে রাখা একটু কষ্টকর হতে পারে। তাই আপেল টমেটোর বৈশিষ্ট্যের ন্যায় অন্য টমেটোও সংরক্ষণে বেশি উপযোগী। তবে প্রাকৃতিক উপায়ে টমেটো সংগ্রহের ক্ষেত্রে একটু বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় বলে তিনি জানান।
প্রাকৃতিক উপায়ে টমেটো সংরক্ষণের জন্য পাকা, আধা পাকা বা রঙ চড়া অবস্থায় টমেটো বোটাসহ গাছ থেকে খুবই সাবধানতার সাথে সংগ্রহ করতে হবে; যেন কোন অবস্থাতেই টমেটো থেকে বোটা আলাদা না হয়ে যায়। এছাড়া সতর্ক থাকতে হবে যেন টমেটোর গায়ে কোন ধরনের আঘাত না লাগে। গাছ থেকে টমেটো সংগ্রহ করার পর বাড়িতে এনে সেগুলোকে বাছাই করতে হবে। যেন কোন টমেটো পোকাযুক্ত ও গায়ে কোন দাগ না পড়ে। সংগ্রহ করা টমেটোর মধ্যে যদি এ ধরনের চিহ্ন যুক্ত কোন টমেটো থাকে তাহলে সেটা সংরক্ষণের জন্য বাছাই না করাই ভালো ভালো বলে তিনি জানান। কারণ এ দাগযুক্ত টমেটো খুব দ্রুত নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাছাইকৃত টমেটোগুলো যে স্থানে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে রাখা হবে সে জায়গা পরিস্কার করতে হবে। স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকতে হবে। এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে যেন সেটা শুষ্ক এবং পর্যাপ্ত আলো বাতাসের ব্যবস্থা থাকে। সাধারণত পাকা ঘরের মেঝে বা শুকনা মাটির জায়গাগুলো সংরক্ষণ স্থান হিসেবে উপযুক্ত। ছায়াযুক্ত, ভেজা ও আলো বাতাসহীন জায়গা হলে টমেটো দ্রুত পচে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার এমনভাবে টমেটোগুলো রাখতে হবে যাতে একটু ফাঁকা ফাঁকা থাকে। একটি টমেটো থেকে আরেকটি টমেটোর মধ্যে আলো বাতাস চলাচল করতে পারে। ঠিক যেভাবে গ্রামের মানুষ বাড়িতে আলু সংরক্ষণ করে থাকে। তবে সংগ্রহ থেকে সংরক্ষণ পর্যন্ত সবগুলো ধাপই খুবই সতর্কতার সাথে অবলম্বন করতে হবে। বীথিকা রাণী নিজেও এই সতর্কতা অবলম্বন করে টমেটো সংরক্ষণের চেষ্টা করছেন।
বাড়িতে চাষ করে এবং যতœসহকারে পরিচর্যার মাধ্যমে এভাবে টমেটো সংরক্ষণ সম্ভব বলে বীথিকা রানী মনে করেন। এভাবে টমেটো রেখেছেন প্রায় ২ মাস হয়েগেছে। ২-৩ দিন পরপর সংরক্ষিত এ টমেটোর মধ্যে থেকে যেটা বেশি পাকা মনে হয়ে সেটা উঠিয়ে নিয়ে খাওয়ার কাজে ব্যবহার করেন। বীথিকা রানী জানান, তার বাবার বাড়িতে প্রচুর টমেটো হয়। তাই তিনি এ পদ্ধতি সম্পর্কে তাদেরকেও জানিয়েছেন; যেন প্রয়োজনে তারাও সংরক্ষণ করতে পারেন। গতবছর তার এক জা (স্বামীর ভাইয়ের স্ত্রী) এ পদ্ধতিতে টমেটো সংরক্ষণ করে প্রায় আষাঢ় মাস পর্যন্ত খাওয়ায় উপযোগী করেছিলেন। সেখান থেকে উৎসাহ পেয়ে এ মৌসুমেও পরীক্ষামূলকভাবে তিনি কাজটি শুরু করেছেন। প্রায় ২৫ কেজির মতো টমেটো তিনি তার ঘরের মেঝেতে রেখেছেন। সংরক্ষণ করা টমেটো থেকে তিনি ১০ কেজি বিক্রিও করেছেন।
বাণিজ্যিক হারে চাষাবাদের কারণে বর্তমান সময়ে যদিও টমেটো সারাবছর বাজারে কিনতে পাওয়া যায় কিন্তু সময়ের সাথে দরদামেরও পার্থক্য থাকে এবং স্বাদের তারতম্যের কারণে অনেকে কিনতে আগ্রহ দেখান না। অনেকসময় ইচ্ছে থাকলেও দাম বেশি হওয়ার কারণে অনেকে কিনতে চান না। আবার সংরক্ষণ করার অভাবে অনেকের বাড়িতে উৎপাদিত হওয়া টমেটো পচে নষ্ট হয়ে যায় বা কম টাকায় বিক্রি করে দিতে হয়। এ সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে তিনি এই সংরক্ষণ পদ্ধতিটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে তিনি অন্যদের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে পরীক্ষামূলকভাবে যাচাই করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন।
এছাড়াও বীথিকা রাণী টমেটো কেটে শুকিয়ে, সস বা আচার করে দীর্ঘদিন সংরক্ষণের চেষ্টা করেন। যাতে করে বাড়িতে উৎপাদিত সবজি কম দামে বিক্রি করা না লাগে। আবার একইসাথে পচে নষ্ট না হয় এবং দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের ব্যবহার উপযোগী করে রাখা যায়।
গ্রামের অনেকেই নিজেদের প্রয়োজন মিটাতে এবং বাজারে বিক্রির মাধ্যমে লাভবান হওয়ার জন্য বাড়িতে সবজি উৎপাদন করে থাকেন। সরবরাহ, সংরক্ষণ ও চাহিদা অনুযায়ী বাজার দর না পাওয়ার দরুণ নষ্ট হয়ে যায় উৎপাদিত ফসলে একটি অংশ। সেক্ষেত্রে ফসল রক্ষায় বীথিকা রাণীর প্রচেষ্টা সামান্য হলেও ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।