প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণ ও জীবনকে সুস্থ রাখি; নিজে সুস্থ হই!
সুকান্ত সেন ও সিলভানুস লামিন
প্রতিবছর ৭ই এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন, স্বাস্থ্য বিষয়ক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান এ দিবসটি পালন করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালনের বিভিন্ন উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে:
১. বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা,
২. বিভিন্ন রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানুষকে তথ্য এবং রোগ প্রতিরোধ বিষয়ক দিকনির্দেশনা দেওয়া,
৩. অসুস্থ মানুষ কিংবা সবচে’ স্বাস্থ্য ঝুঁকি এলাকায় মানুষকে নিয়মিত রক্তচাপসহ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করা
৪. কোন রোগে আক্রান্ত হলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ওষুধপত্র গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা
৫. মানুষের নিজেদের ভেতরে রোগপ্রতিরোধ গড়ে তোলার মানসিকতা তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করা
৬. বিশ্বের বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ তৈরি করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা
৭. স্বাস্থ্য ঝুঁকি এলাকায় বসবাসকারী পরিবার বা মানুষকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেওয়া।
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস প্রথম পালিত হয়েছে ১৯৫০ সালে। ওই বছরে স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো “Know your Health Services” বা আপনার স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে জানুন”। এভাবে প্রতিবছরই একটি নিদির্ষ্ট বিষয়কে প্রতিপাদ্য হিসেবে নির্ধারণ করে দীর্ঘ ৬৫ বছর ধরে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ২০১৫ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ছিলো ”নিরাপদ খাদ্য”। এই বছরের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে “সু-শৃঙ্খল জীবন-যাপন করুন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন”। গত বছর এবং এ বছরের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়গুলোর মধ্যে একটি সাদৃশ্য রয়েছে। নিরাপদ বা ভেজালমুক্ত খাদ্য গ্রহণ করলে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য রোগের আক্রমণও কম হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে সারাবিশ্বে ৪২২ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। ধারণা করা হচ্ছে আগামী ২০ বছরে আক্রান্ত মানুষের এ সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এ রোগে আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুর হার দিনকে দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধুমাত্র ২০১২ সালেই ডায়াবেটিসে মারা যায় ১.৫ মিলিয়ন মানুষ এবং ৮০% এ মানুষ নি¤œ ও মধ্য আয়ের দেশে বাস করেন। সঙ্গত কারণেই ২০১৬ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে ডায়াবেটিসকে প্রতিরোধ করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তবে ডায়াবেটিস ছাড়াও বর্তমানে নানান জটিল রোগের রোগের প্রার্দুভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। জাঙ্ক ফুড, ভেজাল খাদ্য, অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণ করার কারণে আজ বিশ্বে মানুষ মুটিয়ে যাচ্ছে, ক্যানসার, কিডনী, প্রজনন সংক্রান্ত জটিলতাসহ নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এসব রোগ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞগণ অনিরাপদ ও ভেজালযুক্ত খাদ্য গ্রহণকে দায়ি করেছেন।
বারসিক মনে করে, প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎসগুলোকে রক্ষা এবং এ খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল ক্ষুদ্র থেকে শুরু করে বৃহৎ প্রতিটি প্রাণকে তাদের মতো করে থাকার ও বাঁচার সুযোগ করে দিলে বিশ্বে রোগবালাইয়ের প্রার্দুভাব কমে যাবে। কারণ প্রকৃতিতেই প্রতিটি রোগের প্রতিষেধক রয়েছে; প্রকৃতির মাঝেই রয়েছে সব ধরনের রোগ নিরাময় করার মহৌষধ। বিশ্বের যত ধরনের মহৌষধ উদ্ভাবন ও আবিষ্কার হয়েছে সেগুলোর কাঁচামাল প্রকৃতি থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে। অন্যদিকে শুধুমাত্র মানুষের সুস্থতার ওপর গুরুত্বারোপ করলে চলবে না; মানুষ যাদের সহচার্যে, যাদের কল্যাণে বেঁচে আছে সেসব প্রাণ ও উদ্ভিদের সুস্থতার দিকে নজর দিতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মানুষ যে মাছ খায় সেই মাছের খাদ্যে খাদ্যপ্রাণের পরিবর্তে যদি প্রাণনাশের উপাদান থাকে তাহলে সে মাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে না। মানুষ এ মাছ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়বেই। অন্যদিকে মানুষ যে মুরগির মাংস খায়, সেই মুরগির খাবারে যদি বিষ থাকে তাহলে সেই মুরগির মাংস খেয়ে মানুষও বিষক্রিয়া আক্রান্ত হবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তেমনিভাবে বলা যায়, মানুষ যে ভাত, গম বা শাকসবজি খায় ওইসব খাদ্যে ও শাকসবজির উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যন্ত যদি মানবস্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান থাকে তাহলে কোনভাবেই সেই খাদ্য মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী হবে না। উপরোন্তু এসব রাসায়নিক উপাদান মাটি, পানি, বায়ুকেও দূষিত করবে। এই দূষিত বায়ু, মাটি ও পানির প্রভাব পড়বে মানুষের ও অন্যান্য প্রাণসমাহারের জীবনের ওপর। মাটি যদি সুস্থ না থাকে, মাটি যদি বিষে ভরপুর থাকে, তাহলে মাটিতে যেসব শস্য-ফসল উৎপাদিত হবে সেগুলোও বিষাক্রান্ত হবে। এ শস্য-ফসল গ্রহণ করে মানুষ সুস্থ থাকতে পারে না। তাই মানুষের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য এবং তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য প্রয়োজন প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানকে সুস্থ রাখা।
প্রকৃতির মধ্যে যে বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে যেগুলোকে কোন না কোনভাবে মানুষ খাদ্য হিসেবে এবং ওষুধ হিসেবে গ্রহণ করে সেসব প্রাণী ও উদ্ভিদের স্বাস্থ্যের দিকেও দৃষ্টিপাত দেওয়া উচিত বলে বারসিক মনে করে। প্রকৃতির মাঝে ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ যত ধরনের প্রাণ ও উদ্ভিদের স্বাস্থ্য ভালো থাকলে মানুষের স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে; প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎসও বেড়ে যাবে। ভেজালহীন ও নিরাপদ প্রাকৃতিক খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে মানুষ সুস্থ থাকবে ।
বারসিক মনে করে, প্রতিষেধকের চেয়ে রোগ প্রতিরোধ করাই সর্বত্তম পন্থা হওয়া উচিত। প্রতিষেধক ব্যবস্থায় আর্থিক সম্পর্ক রয়েছে। দরিদ্র মানুষের পক্ষে অনেকসময় ব্যয়নির্ভর প্রতিষেধক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। উপরোন্তু, রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবার নানান অব্যবস্থাপনা, বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় অতিমুনাফা এবং বাণিজ্যের কারণে এসব স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারছেন না অনেক দরিদ্র ও নিম্বমধ্যবিত্ত মানুষ। বারসিক মনে করে, মানুষের স্বাস্থ্যকে সুন্দর রাখার জন্য রাষ্ট্রের যে চলমান স্বাস্থ্য কাঠামো রয়েছে সেগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা নিশ্চিত করতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে যে কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে কিংবা উপজেলা পর্যায়ে যে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে সেগুলোতে যাতে দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের অভিগম্যতা থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে। এসব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর কার্যক্রম পরীবিক্ষণ করা এবং চিকিৎসাব্যবস্থায় সাধারণ ও দরিদ্র মানুষের চাহিদাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। প্রতিটি স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান তথা সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, কমিউনিটি ক্লিনিক ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স-এ চিকিৎসা নিতে এসে যাতে সাধারণ মানুষ প্রতারণা ও হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে যেমন দৃষ্টি দিতে হবে ঠিক তেমনি দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার, নার্স বা স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকর্তা যাতে তাদের দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করেন সেদিকেও মনোযোগ দিতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্টদের।
এ বছরের বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বলতে হয়; D-তে Diabetes আবার D-তে Discipline। ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞদের মতে, সুশৃঙ্খল জীবনব্যবস্থা পরিচালনার মাধ্যমে ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বারসিক মনে করে, প্রকৃতির নিজস্ব শৃঙ্খল ব্যবস্থা রয়েছে। মানুষ নিজেদেরকে ‘জয়ী’ ও ‘অতিক্ষমতাশালী’ ভাবার কারণেই প্রকৃতির এই সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাকে বিনষ্ট করার দুঃসাহস দেখিয়েছে। এভাবে প্রকৃতির বুকে বেড়ে ওঠা প্রতিটি প্রাণ, জীবন এবং বৈচিত্র্য ধ্বংস বা ধ্বংস হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে বলে প্রকৃতিতে এবং এর ছন্দময় জীবনব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। ফলশ্রুতিতে বিশ্বে সামাজিক ও শারীরিক অসুস্থতা বেড়েই চলেছে। তাই প্রকৃতিকে সাথে নিয়েই এবং প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণ ও জীবনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমরা ডায়াবেটিসহ অন্যান্য রোগ ও অসুস্থতা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি; রক্ষা করতে পারি নিজেকে এবং সৃষ্টির অন্যান্য জীবন ও প্রাণকে!