ওরা উদ্যোগী, ওরা প্রতিবাদী
মানিকগঞ্জ থেকে রাশেদা আক্তার
আমাদের সমাজে অনেক সোনিয়া, রিক্তা, বর্ষা, উম্মে নিশার মত কিশোরীরা আছে যারা তাদের সমস্যার কথা কাউকে বলতে পারে না। সামান্য একটু সহযোগিতা পেলে তারাও অন্যদের মত নিজেদের বিকশিত করে সমাজে ভূমিকা রাখতে পারে। আবার সমাজে এখনো এমন কিছু মহৎ ও আদর্শ শিক্ষক আছেন যারা প্রকৃত অর্থেই সমাজ নির্মাণের কারিগর। যারা বিশ্বাস করেন ও মনে ধারণ করেন যে, প্রতিটি শিক্ষার্থীকেই ‘মেয়ে’ হিসেবে নয় ‘মানুষ’ হিসেবে দেখা উচিত। তাঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও সাহসিকতায় আজও নানা ধরণের হয়রানির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে সোনিয়া, রিক্তারা, লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারছে হাজারো বর্ষা, উম্মে নিশারা। এমনই কিছু উদ্যোগী, সাহসী ও প্রতিবাদের গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে নিচের লেখাটি।
দিয়ারা ভবানীপুর গ্রামের পাশের গ্রাম মহেশপুরে বাস করেন রিক্তা মনি। রিক্তা মনি এবং কয়েকজন কিশোরী প্রতিদিন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। তাদের প্রতিদিনের আলোচনায় স্থান পায় কিশোরীদের বিভিন্ন সমস্যা এবং সমস্যা থেকে উত্তরণের পথসহ অন্যান্য সমসাময়িক বিষয়। তাদের আলোচনায় অবশ্য স্থান পায় বয়োঃসন্ধিকাল, ন্যাপকিন ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা, বাল্য বিবাহের কুফল, মাদক, নিরাপদ খাবার, পরিবেশ সংরক্ষণ প্রভৃতি বিষয়। ধীরে ধীরে আরও বেশ কয়েকজন কিশোরী এই আলোচনায় যোগ দেন। এভাবে চলতে থাকে প্রায় এক বছরের বেশি সময়। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০ জন সদস্য নিয়ে এবং এর মধ্যে ৫ জনকে নিয়ে বিশেষ কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে ‘‘মানবকল্যাণ কিশোরী সংগঠন’’ নামে সংগঠনে রূপ ধারণ করে।
ওরা উদ্যোগী
খানবাহাদুর আওলাদ হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রিক্তা আক্তার। তার বাবা স্থানীয় বাজারে চায়ের দোকান করে। স্কুলের বেতন দিতে না পারায় রিক্তা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। বিষয়টি সভায় কিশোরীরা উত্থাপন করে। রিক্তা আক্তারের বাড়িতে তখন সভা ডাকা হয় এবং রিক্তা মনির বাবা-মায়ের সাথে কথা বলা হয়। রিক্তা লেখাপড়া করার আগ্রহ প্রকাশ করলে সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, মত্ত স্কুলে রিক্তাকে ভর্তির ব্যাপারে সহযোগিতা করা হবে। তখন মত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ করে তাকে ভর্তি করানো হয়। বর্তমানে রিক্তা বিনা বেতনে লেখাপড়া করছে ।
কিশোরী সংগঠনের অপর সদস্য বর্ষা আক্তার এবং উম্মে নিশা। এরা দুই বোন। বাবা কৃষি কাজ করেন। বর্ষা নবগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণীতে পড়ে। উম্মে নিশা নবগ্রাম স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হবে। কিন্তু উভয়ের পড়াশুনার জন্য বেতন দেয়ার সক্ষমতা তাদের বাবা-মায়ের ছিল না। সংগঠনের সভায় আহবায়ক রিক্তা মনি বিষয়টি উত্থাপন করে এবং বর্ষা-নিশার মা তাদের সংকটের কথা জানান। সভায় সিদ্ধান্ত হয় বিষয়টি নিয়ে স্কুলে যোগাযোগ করা হবে। তখন বর্ষা ও নিশার বাবা ও রিক্তামনি নবগ্রাম স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ করলে নিশাকে স্কুলে ভর্তি করার ক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা করে এবং প্রধান শিক্ষক নিশার বেতন সম্পূর্ণ ফ্রি করে দেন। তিনি আশ্বাস দেন যতদিন সে লেখাপড়া করবে বিনা বেতনে করবে। সেই সাথে উম্মে নিশার বোন বর্ষা আক্তারের বেতন হাফ করে দেওয়া হয়।
ওরা সাহসী
সংগঠনের সদস্য সোনিয়া আক্তার ও রিক্তা আক্তার ৮ম শ্রেণীতে লেখাপড়া করে। তারা স্কুলে যাবার পথে একটি বখাটে ছেলে তাদের প্রতিদিন নানা ধরণের বাজে কথা বলতো। সেদিন স্কুলে যাবার পথে ছেলেটি আবার তাদের বাজে কথা বললে তারা বলে ‘আমরা কিন্তু স্যারের কাছে বলে দিব’। ছেলেটি তাও তাদের বিরক্ত করে। তখন তারা স্কুলে গিয়ে প্রধান শিক্ষককে বিষয়টি অবহিত করলে প্রধান শিক্ষক লোক পাঠিয়ে ঐ বখাটে ছেলেটিকে ধরে নিয়ে আসে এবং স্কুল কমিটির সভাপতিকে ডেকে তার বিচার করেন। এর ফলে ছেলেটিকে আর কখনো তাদের বিরক্ত করতে দেখা যায়নি।
ওরা প্রতিবাদী
কিশোরীরা উদ্যোগ নিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধে ভূমিকা রাখছে। সংগঠনের সভায় বাল্য বিবাহের কুফল বিষয়ক ভিডিও ডকুমেন্টরি প্রদর্শন করা হয়। সেখানে তারা শপথ নেয় তারা নিজেরা বাল্য বিবাহ করবে না এবং যেখানেই বাল্য বিবাহ হবে তারা প্রতিবাদ করবে। সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সংগঠনের সদস্য সোনিয়া আক্তার ও শিরীন আক্তার ৭ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তাদের পরিবার থেকে তাদের বিবাহের কথা বললে তারা বিষয়টি সংগঠনে আলোচনা করে। পরে তাদের পরিবারে (মা-বাবার) বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়। তাদের মায়েদের বাল্য বিবাহের কূফল বিষয়ে বুঝানো হয়। অবশেষে তারা তাদের মেয়েকে বিয়ে দেবেন না বলে জানান। বর্তমানে তারা দুজনেই ৮ম শ্রেণীতে লেখাপড়া করছে। বাল্য বিবাহ বন্ধে শিরীন আক্তারের আগ্রহ এবং উৎসাহ অনেক বেশি। শিরীন বলে, “আমি তো এখন বিয়ে করবোই না, কারো বাল্য বিয়ে হতেও দেব না।”
বাল্য বিবাহ বন্ধে কিশোরীরা কাজ করে যাচ্ছে। দিয়ারা ভবানীপুর গ্রামের পাশের গ্রাম চর হিজুলী। গ্রামটি মানিকগঞ্জ পৌরসভার অন্তর্ভূক্ত। ওই গ্রামের ৬ষ্ঠ এবং ৭ম শ্রেণীতে পড়া দুইটি মেয়ের বিয়ের সংবাদ পায় কিশোরীরা। তারা বিয়ের সত্যতা যাচাই করে বড়দের কাছ থেকে। তারপর সংগঠনের সভায় বিষয়টি উৎত্থাপন করে। ঘটনাটি জেলা প্রশাসক, ইউএনও, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, এনজিও প্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের জানানো হয়। এভাবে কিশোরী সংগঠনটির হস্তাক্ষেপে বাল্য বিয়ে থেকে রক্ষা পেলো ওই দু’টি মেয়ে।
এই পথচলা কিশোরীদের মধ্যে এনে দিয়েছে আত্মবিশ্বাস, সাহস আর সংগ্রামী মনোভাব। এই পথচলায় সম্পৃক্ত হবে হাজোরো নতুন কিশোরী। এই প্রবাহ প্রবাহিত হবে পরবর্তী প্রজন্মে। স্বপ্ন দেখে এক সুন্দর ব্যক্তিগত, পরিবার এবং সমাজ নির্মাণের।