প্রসঙ্গ: একটি মৎস্য ব্যাংক
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে পার্থ সারথী পাল
“মাছের জন্য ব্যাংক” কথাটি শুনতে অন্যরকম মনে হলেও তা বাস্তবে করে দেখিয়েছেন শ্যামনগরের কিছু উদ্যোগী মানুষ। সাধারণত ব্যাংকে টাকা পয়সা থাকলেও এ ব্যাংকে থাকে মা-মাছ। অতীতে শুস্ক মৌসুমে এলাকার খাল, বিলের মাঝে ডোবায় অথবা বিলের পাশের পুকুরে কিছুটা হলেও পনি থাকতো যেখানে দেশী প্রজাতির মা-মাছ টিকে থাকত। এভাবে পরবর্তী বর্ষা মৌসুমে বংশবিস্তারের সুযোগ পেতো তারা। তবে বর্তমান জলবায়ু পরিবর্তনসহ মানুষের বিভিন্ন উন্নয়ন উদ্যোগের ফলে শুস্ক মৌসুমে দেশী প্রজাতির মাছের টিকে থাকার আশ্রয়স্থ অবশিষ্ট আর নেই বললেই চলে। এছাড়াও মানুষের অতিলোভ ও নির্বিচারে ডিমওয়ালা মাছ নিধনের কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছ দিনকে দিন হারিয়ে যেতে বসেছে। এমন একটি সঙ্কটময় সময়ে দেশী প্রজাতির মা-মাছ সংরক্ষণে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী ইউনিয়নের “মধ্য কৈখালী মল্লিকপাড়া আইপিএম কৃষক ক্লাব”।
“মধ্য কৈখালী মল্লিকপাড়া আইপিএম কৃষক ক্লাব” ক্লাবে সভাপতি মো. হাবিবুর রহমানের দেয়া তথ্যমতে, এ সংগঠনের যাত্রা শুরু হয় ২০০৩ সালে। বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৫১। সদস্যদের মধ্য রয়েছেন কৃষক, শিক্ষক, জেলে, কৃষিবিদ, শিক্ষার্থী, যুবক, সমাজসেবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ। মূলত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি বিষয়ে প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে কৃষি বিষয়ে বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথে সাথে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম শুরু করে এই সংগঠন। এভাবে এলাকায় বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও পরিচিতি লাভ করে এই সংগঠন। এই সংগঠনের বহুমাত্রিক কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম দেশী প্রজাতির মা-মাছ সংরক্ষণ করা। উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সংগঠনের সদস্যরা ২০০৫ সালে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই উদ্যোগের মাধ্যমে তাঁরা গ্রামের মাঝের শৈলখালী বিলের (স্থানীয়ভাবে পাঁচশবিঘা বিল নামে বেশি পরিচিত) কাছে অবস্থিত পুকুরে দেশী প্রজাতির মা মাছ সংরক্ষণের কার্যক্রম শুরু করেন। এ পুকুরকেই তারা মাছের ব্যাংক হিসাবে উল্লেখ করেন।
সাধারণত নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে যখন বিলের পানি শুকাতে শুরু করে তখন পুকুর দু’টিকে বিশেষ নজরদারিতে রাখেন তাঁরা। এ সময়ে তারা ওই পুকুর দু’টি থেকে কোনো ধরনের মাছ সংগ্রহ করেন না। এরপর বর্ষার সময় এ পুকুর দু’টি বিলের সাথে উন্মুক্ত করে দেন যাতে করে সমগ্র বিলে মা-মাছ ছড়িয়ে পড়ে। মে থেকে জুলাই পর্যন্ত বিলের ভেতর মাছ ধরা বন্ধ রাখেন তারা। কারণ এ সময় মাছের প্রজনন সময়। মাছ ধরা বন্ধ করার কারণে এসময় মাছগুলো প্রজননের সুযোগ পায় ও ডিম পাড়তে পারে। তারাসহ এলাকার জেলেরা বিলের ভেতর মাছ ধরার জন্য কখনও কারেন্ট জাল ব্যাবহার করেন না। সার্বক্ষণিক কড়া নজরদারিতে রাখার কারণে কেউ সেখানে অবৈধ কারেন্ট জাল ব্যবহার করে মাছ ধরতে পারেন না। সংগঠনের সদস্যরা জানান, বিগত সময় কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করার জন্য সংগঠনের সদস্যগণ কারেন্ট জাল জব্দ করে পুড়িয়ে ফেলেছেন। এছাড়াও ডিমওয়ালা মাছ ধরা থেকে সবাইকে বিরত থাকার জন্য তাঁরা নানাভাবে সচেতনতা ও প্রচারণা করেন।
এভাবে তাঁদের একনিষ্ঠ উদ্যোগের ফলে বিলের ভেতর মা মাছ প্রজননের সুযোগ পায়। বিলের পানি নিস্কাষনের জন্য এর মধ্য যে খালটি পার্শবর্তী কালিন্দি নদীর সঙ্গে যুক্ত সেখানে পাটা দিয়ে রাখেন যেন মাছ বাইরে যেতে না পারে। বর্ষা মৌসুমে সংগঠনের সদস্যরা এলাকার গরিব মানুষকে এ বিল থেকে মাছ সংগ্রহ করর সুযোগ দেন যাতে তারা তাদের দৈনন্দিন মাছের চাহিদা পূরণ করতে পারেন। তবে বহিরাগত কাউকে এ বিল থেকে মাছ সংগ্রহ করতে দেওয়া হয় না বলে সংগঠনের সদস্যরা জানান।
বর্তমানে সংগঠনের সদস্যরা ব্যক্তি মালিকাধীন দু’টি পুকুরকে মৎস্য ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পুকুরের মালিক স্বেচ্ছায় এ কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছেন। সংগঠনটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুকুর দু’টি থেকে যে মাছ উৎপাদন হবে তা ন্যুনতম মূল্যে পুকুরের মালিককে দেওয়া হবে। বর্তমানে পুকুর দু’টিতে দেশী প্রজাতির মাছের মধ্য আছে কৈ, শোল, টেংরা, মাগুর, শিং, লাঠা, পুটি ইত্যাদি। সংগঠনটির এমন উদ্যোগের ফলে এলাকায় দেশী প্রজাতির মাছ প্রজননের সুযোগ পাচ্ছে এবং সংরক্ষিত হচ্ছে। প্রকৃতি থেকে যখন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে দেশী জাতের মাছ সেখানে উপকূলীয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এ ধরনের সংরক্ষণ উদ্যোগ নিশ্চয়ই দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষা ও সংরক্ষণে উৎসাহী হবেন। এ মৎস্য ব্যাংক দেশের অন্যান্য এলাকার জেলেসহ অন্য মানুষকে অনুপ্রাণীত করুক।