বিলাতি ধনিয়াসহ বৈচিত্র্যময় শস্য চাষ করে সফল সবিতা আক্তার
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
নানা রকমের বৈচিত্র্যময় ফসলের শস্যভান্ডার আটপাড়া উপজেলা স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের নোয়াপাড়া গ্রাম। এই গ্রামের বাসিন্দা সবিতা আক্তার। বয়স ৩৫ বছরের বেশি। স্বামী এবং এক ছেলে ও তিন মেয়েসহ ছয় জনের অভাবের সংসার তাঁর। একটি জড়াজীর্ণ বাড়ি এবং ১০ শতাংশ জমি সবিতা আক্তাররের মূল সম্বল। মূল পেশা কৃষাণী । নোয়াপাড়া গ্রামে বধু হয়ে আসেন তিনি প্রায় ১৭ বছর আগে। বিয়ের পর থেকে অভাবের সংসার সামাল দেওয়ার পাশাপশি বাড়ির চারপাশ পরিবেশসম্মত ও রুচিশীলভাবে সাজিয়ে তোলেন। বিয়ের আগে তাঁর স্বামীর অনেক জমি ছিল। জমি বিক্রি করতে করতে এখন শুধু বাড়ির ভিটার ১০ শতাংশ জমি আছে। সংসারের অভাব দূর করার জন্য বিয়ের পর থেকে সবিতা আক্তার শাকসবজি চাষ শুরু করেন।
সবিতা আক্তারের স্বামী হান্নান মিয়া রিকশা চালাতেন। সবিতা আক্তার মানুষের বাড়িতে কাজ করতেন। ছোট বেলায় মায়ের হাত ধরেই কৃষি কাজ (বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিনিময়) শিখেছিলেন। তিনি নিজের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বাড়ির চারপাশে শাকসবজি চাষ শুরু করেন। তিনি হাঁস-মুরগি, গরু ছাগল পালন শুরু করেন। উৎপাদিত শাকসবজি বাজারে বিক্রি করে কোন রকম সংসার চালাতেন। সবজি চাষের পাশাপাশি ঘরের পাশের এককোনায় বিলাতি ধনিয়া চাষ করেন তিনি। সেই ধনিয়া পাতা বাজারে বিক্রি করেন প্রায় ২০০০ টাকায়। ধনিয়া চাষে আর্থিক লাভ দেখে তিনি ধনিয়া গাছ থেকে নিজেই বীজ সংরক্ষণ করেন এবং পরবর্তীতে তিনি ১০ শতাংশ জমিতে চাষ করেন। চাষের প্রথম বছর তিনি প্রায় পাঁচ হাজার (৫,০০০) টাকার ধনিয়া বিক্রি করেন। এভাবে পর্যায়ক্রমে তিনি ১৬ শতাংশ জমিতে ধনিয়া পাতা চাষ করেন। ধনিয়া চাষে তিনি শুধুমাত্র গোবর, ছাই, মুরগির বিষ্ঠা ও কঁচুরিপানা দিয়ে সার তৈরি করে জমিতে ব্যবহার করেন। ধনিয়া চাষে তার কোন নগদ টাকার প্রয়োজন হয় না। ১৬ শতাংশ জমিতে উৎপাদিত ধনিয়া পাতা তিনি প্রায় ২৫,০০০ (পঁচিশ) হাজার টাকায় বিক্রি করেন।
এই প্রসঙ্গে সবিতা আক্তার বলেন, “এখন আমি আর বাজারে গিয়ে ধনিয়া পাতা বিক্রি করি না। পাইকাররা বাড়ি থেকে সমস্ত পাতা কিনে নিয়ে যায়।” প্রতিবছরই বীজ সংরক্ষণ করে ধনিয়া পাতা চাষ করেন, বাজারের বীজের উপর তাকে নির্ভর করতে হয় না। ২০১৪ সালে তিনি প্রায় ছয় হাজার টাকা খরচ করে জমি লিজ নিয়ে ২০ শতাংশ জমিতে ধনিয়া চাষ করেন। এভাবে ধনিয়া পাতা চাষ করে তিনি এবছরে প্রায় দুই লাখ টাকা আয় করেন। আয়ের টাকায় তিনি ১০ শতাংশ জমি কিনেন, ৪০ হাজার টাকার জমি লিজ নেন এবং ঘর মেরামত করে সৌরবিদ্যুৎ এর সংযোগ দেন।
একই জমিতে বার বার ধনিয়া পাতা চাষ না করে মাটিকে সুস্থ রাখার জন্য তিনি বৈচিত্র্যময় ফসল যেমন-বেগুন ও মরিচ চাষ শুরু করেন। তার ধারণা একই জমিতে বার বার একই ফসল চাষ করলে জমির ফলন কমে যায়। তিনি স্থানীয় জাতের বেগুণ ও মরিচের বীজ সংরক্ষণ করেন। ২০১৫ সালে তিনি প্রায় এক লাখ টাকার ধনিয়া পাতা বিক্রি করেছেন। চলতি বছর ধনিয়ায় পোকার আক্রমণ বেশি এবং গাছ লাল হয়ে মারা যাওয়ায় তিনি ধনিয়া পাতার জমিতে বেগুণ ও মরিচ চাষ করার জন্য বীজতলা তৈরি করেছেন। এক মৌসুম বেগুণ ও মরিচ চাষ করে পরের মৌসুমে তিনি আবার ওই জমিতে বিলাতি ধনিয়ার পাতা চাষ করবেন। তিনি বলেন, “আমি যত দিন বেঁচে থাকব ততদিন ধনিয়া পাতা চাষ করব”। তিনি বাড়ির আশেপাশে মিষ্টি লাউ, কুমড়া, লাউ, সীম, হলুদ ও আদা চাষ করেন। তার স্বামী হান্নান মিয়া এখন আর দিনমজুরের কাজ করেন না।
সবিতা আক্তার কৃষকদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন। তাঁর ধনিয়া পাতার চাষ দেখে গ্রামের আরও ৫ জন কৃষক ধনিয়া পাতা চাষ শুরু করেছেন। অল্প পূঁজিতে এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়া পরিবেশের ক্ষতি না করে ধনিয়া চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ায় সমাজে সবিতা রাণীর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারছেন। সবিতা আক্তার তার গ্রামের অন্যান্য কৃষাণ-কৃষাণীদের মাঝে স্থানীয় জাতের বীজ সরবরাহ করেন। আগে কৃষাণীদের মাঝে বীজ বিনিময় প্রথা চালু থাকলেও এখন বাজারে হাইব্রিড বীজ আসাতে কৃষাণ-কৃষাণীরা বাজারের বীজের উপর নির্ভশীল হয়ে পড়েছে। সবিতা আক্তারের কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ওই গ্রামের নারীরা এখন সবজি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন এবং তাদের মাঝে আবার বীজ বিনিময়ে প্রথা চালু হয়েছে ।
সবজিতে যদি কোন পোকা আক্রমণ হয় তখন নিজেই তিনি এগড়া পাতা দিয়ে ঔষধ তৈরি করে জমিতে প্রয়োগ করেন। তিনি বলেন, “আমি যে ফসল নিজে চাষ করি, সেসব ফসলে কোন কৃত্রিম সার, বিষ দেই না। সবিতা আক্তার পরিকল্পনা করেন নিজে বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির শস্য-ফসল বীজ সংগ্রহ করে অন্যের মাঝে বিতরণ করবেন। যাতে সবাই স্থায়িত্বশীল ও পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চা করেন।