পলিব্যাগের শব্দ তাড়াবে ইঁদুর
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
সবুজ ধান ক্ষেত। গোছায় গোছায় সোনালি ধান বাতাসে দোল খাচ্ছে। এ ছবিটি সকলের চেনা। কিন্তু এই ধানে ভরা জমিতে যদি হঠাৎ করে ইঁদুরের আক্রমণ হয় তাহলে কৃষকের সব কষ্টই বৃথা। স্বরমশিয়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামের হাবিবুল্লাহ খাঁন। তিনি পেশায় একজন চাকুরীজীবী। কিন্তু নিজের জমিতে তিনি নিজেই চাষাবাদ করেন। বিগত ২/৩ বছর যাবৎ তাঁর জমিতে ইঁদুরের আক্রমণ শুরু হয়। তিনি প্রতিদিন সকালে জমিতে গিয়ে দেখতেন ধানের গোছা মাটিতে পড়ে আছে। তিনি ভেবেছিলেন হয়তো কেউ তাঁর সাথে শত্রুতা করে গোছা কেটে রেখেছেন। আবার এও ভাবলেন যে কেউ এরকম করলে তো পুরো জমির ধান কেটে নিত। তারপর সারা জমিতে হেঁটে হেঁটে তিনি বেশ কয়েকটা ইঁদুরের গর্ত দেখতে পেলেন। তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে তাঁর জমিতে ইঁদুর লেগেছে।
আমাদের দেশে ফসলের জন্য অন্যান্য পোকামাকড়ের মত ইঁদুরও এক ধরণের ক্ষতিকর প্রাণী। এরা ঘরে থাকা বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য যেমন খেয়ে ফেলে, তেমনি জমির ধান, সবজি ইত্যাদিও নষ্ট করে। ধানের গোছায় যখন থোড় আসে তখনই ইঁদুরের আক্রমণ শুরু হয়। জমিতে গর্ত করে দিনের বেলায় সেখানে লুকিয়ে থাকে। রাতে বের হয়ে জমির ধান কাটা শুরু করে। হাবিবুল্লাহ খাঁন বলেন, “আমি যহন জমিতে গর্ত দেখছি তহনই বুঝছি যে এর ভিতরেই ইন্দুর আছে। দুই দিন গর্তে পানি ঢালছি কিন্তু ইন্দুর মরে নাই, জমি ছাইড়াও যায় নাই। কিন্তু আমার ধান কাইট্টা নষ্ট করতাছে। এই অবস্থায় ধান কিভাবে রক্ষা করা যায় সেই চিন্তা শুরু করলাম”। তিনি বলেন, “ছোড সময় দেখতাম লিচু গাছে টিন বাইন্ধা রাখতো। আর একটা দড়ি থাকতো ঘরে। দড়ির এক মাথায় একটা কাঠি বান্ধা থাকতো। এই দড়ি ধইরা টান দিলে শব্দ হইতো। গাছে পাখি বা বাঁদুর বইলে ভয়ে উইরা (উড়ে) যাইতো। গাছের লিচু নষ্ট হইতো না”। তিনি আরও বলেন, “চিন্তা কইরা দেখলাম আমারও এই রকম কিছু করন লাগবো। যাতে ইন্দুর গুলান জমি ছাইড়া পালায়। ইন্দুর যেহেতু রাইতে ধান কাডে, তাই টিন বা দড়ি দিয়া কাম অইতোনা। কারণ কোন সময় ইন্দুর আইবো, আবার কোন সময দড়ি ধইরা টান দিমু। আর ধানের জমি তো বাড়ি থেইক্যা অনেক দূরে”।
হাবিবুল্লাহ খাঁন তাঁর জমিতে কীভাবে ইঁদুর তাড়াতে সক্ষম হয়েছেন সে সম্পর্কে বলেন “আমি শেষে বুদ্ধি কইরা বাইর করলাম জমিতে এমন কিছু দেওন লাগবো, যা সব সময় শব্দ করে। জমিতে কয়েকটা বাঁশের কইঞ্চা কুইপ্যা তার মধ্যে ছোট ছোট পলিথিন ব্যাগ বাইন্ধ্যা দিলাম টানাইয়া। বাতাস আইলেই এই ব্যাগ উড়ে আর শব্দ করে। যে কোন ছোড প্রাণি শব্দ ভয় পায়। আবার রাইতের বেলা ব্যাগের ছায়াডাও জমিতে পড়ে। শব্দ আর ছায়া দেইখ্যা ইন্দুর ভয় পায়, মনে করে কেউ বুঝি তারে ধরতে আইতাছে। তাই গর্ত থেইক্যা বাইর অয়না”।তিনি জানান, এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে কয়েকদিন পর জমিতে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করেন তার ধানের জমি অক্ষত রয়েছে। ইঁদুর কোন গাছেই কাটেনি। তাঁর ক্ষেত থেকে ইঁদুর পালিয়ে গেছে। তিনি অনেক কৃষককে এই পদ্ধতি অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছে বলে জানান।
হাবিবুল্লাহ খানের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে একই গ্রামের কৃষক মো. খালেদ বলেন, “আগে তার কাছে শুনছিলাম যে তিনি জমিতে ব্যাগ টানাইয়া ইন্দুর দৌড়াইছে। বিশ্বাস করি নাই। কিন্তু একদিন নিজের চোখে দেইখ্যা আইছি। পরে বিশ্বাস অইছে। আমার জমিতে ইন্দুর লাগলে আমিও এই রকম ব্যবস্থা নিয়াম”।
কৃষকের জ্ঞান, অভিজ্ঞতাই বাঁচিয়ে রেখেছে আমাদের কৃষি ও জীবনযাত্রা। প্রকৃতি এবং বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করেই টিকে আছে আমার দেশের মানুষ।