হরিরামপুরে মিশ্র ফসল চাষের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে সত্যরঞ্জন সাহা ও মুকতার হোসেন
“আমরা জমিতে মিশ্র ফসল চাষ করে লাভবান হয়েছি। মিশ্র ফসল চাষে পোকা কম লাগে, জমিতে বিষ দিতে হয় না। মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়, চাষাবাদে লাভ হয় বেশি। মিশ্র ফসল চাষে পর্যায়ক্রমে ফসল উঠতে থাকে, সহজে ফসল ঘরে তুলা যায়। কৃষকদের নিকট বিভিন্ন ধরনের ফসলের বীজ থাকে, ফলে চাষাবাদে খরচ কম হয়।” মিশ্র ফসল চাষবাসে লাভবান হওয়া প্রসঙ্গে উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার দড়িকান্দির কৃষক বজলুর রহমান (৪৫)।
হরিরামপুর উপজেলা রামকৃষ্ণপুর, ছেড়াগঞ্জ, হারুকান্দি, সুতালড়ি, আজিমনগর, ধুলসুড়া ইউনিয়ন পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত। পদ্মা নদীর ভাঙা-গড়ার মাধ্যমে কৃষিজমি কমে যাওয়া ও পলি পড়ায় মিশ্র ফসল চাষে উদ্যোগ বৃদ্ধি পায়। মিশ্র ফসল চাষে কৃষকদের সফলতায় অন্য কৃষকদের উৎসাহিত করে তুলে। বর্ষায় চরের জমিতে পলি পড়ায় এগুলো উর্বর হয়। ফলে কৃষকরা বাইরের কোন ধরনের উপকরণ ব্যবহার না করেই সেখানে ফসল ফলাতে পারেন। বিশেষ করে রবি মৌসুমে মাটির জু বুঝে তাঁরা ৩টি চাষ করে একই জমিতে ৩ থেকে ৪টি ফসল চাষ করেন। রবি মৌসুমে ব্যাপকভাবে চাষকৃত ফসলগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো- মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, ধনিয়া, ছোট সহজ, চৈতা সরিষা, তিশি, মুসুরি ডাল, পায়রা ইত্যাদি। ফসলী জমিতে দেখা যায় যে, মিশ্র ফসল হিসেবে কৃষকরা মুসুরি ডালের সাথে চৈতা সরিষা ও চারপাশে ধনিয়া চাষ করেন। আবার মটর কালাইয়ের সাথে তাঁরা শ্বেতী সরিষা ও জমির চারপাশ দিয়ে ধনিয়া সজ চাষ করেন। জমিতে রসুন ও পেঁয়াজের সাথে বাঙ্গি চাষ এবং বাদামের সাথে তিল, কাউন ব্যাপকভাবে চাষ করেছে। এছাড়া মিশ্র ফসল চাষে লাভবান হওয়ার বিষয়টি কৃষকরা আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে অন্যান্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেন। এতে করে এলাকায় মিশ্র ফসলের চাষ বিস্তার ঘটটে শুরু করে।
এলাকার কৃষকরা শুধুমাত্র মিশ্র ফসলই চাষ করেন না বরং মিশ্র ফসল যাতে ভালো করে চাষ করা যায় সেজন্য তারা পরস্পরের সাথে উক্ত ফসলের বীজও বিনিময় করেন। এভাবে দেখা যায়, লেছড়াগঞ্জ চর উন্নয়ন সংগঠনের সদস্যগণ ২০১৩ সালে বরুন্ডি বীজ বাড়ি (কৃষক নেতৃত্বে প্রায়োগিক মসলা গবেষণা প্লটের বীজ) থেকে পায়রা, শ্বেতী শরিষা, চৈতা শরিষা, তিশি (মইষনা), কালিমোটর, ডাবরি, মটর কলই, রাধুনী সজ, দেশী গম বীজ পরস্পরের সাথে বিনিময় করেন। কৃষকগণ হারিয়ে যাওয়া বীজ চাষাবাদ করে কৃষক পর্যায়ে বিস্তার ঘটাতেও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই প্রসঙ্গে পাটচরগ্রামের কৃষক সেলিম মিয়া (৩৫) বলেন, “এলাকার কৃষকদের চাহিদার প্রেক্ষিতে রবি মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষাবাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের ফসলের বীজ তাদের মাঝে বিতরণ করা হয়।” তাছাড়া কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদের তথ্য ও বীজ বিনিময় করে চাষাবাদের ফলে জাত সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কৃষকরা জানান, মিশ্র ফসল চাষের মাধ্যমে তাঁরা একই মৌসুমে একাধিক ফসল ঘরে তুলতে পারেন। এসব ফসলে আবাদে পোকার আক্রমণ কম ও পরিবারের নিজস্ব শ্রমে চাষ ও ফসল উৎপাদন করা যায় বলে উৎপাদন খরচ কম হয়। একই সময়ে একাধিক ফসল আবাদ করায় একই খরচে তাঁরা একাধিক ফসল ঘরে তুলতে পারেন। এই প্রসঙ্গে দড়িকান্দি গ্রামের কৃষক আব্দুল মালেক (৪০) বলেন, “আগে একেক জন কৃষকের (এক পাখি সমান ৩৩ শতাংশ জমি) ১০ পাকি, ১৫ পাকি জমি ছিল। কিন্তু পদ্মা নদী ভাঙনের ফলে আমাদের জমির পরিমাণ কমে গেছে। এজন্য অল্প জমিতে একই খরচে একাধিক ফসল চাষ করে আমরা লাভবান বেশি হই।”
কৃষকগণ মনে করেন পদ্মা নদীর পলিযুক্তি মাটি মিশ্র ফসল চাষে খুবই উপযোগী। প্রতিবছর বন্যার পনিতে পলির মাধ্যমে মাটি নতুন হয়। চাষ উযোগী একাধিক ফসল আবাদ করেই কৃষকরা লাভবান হতে পারেন।