মানিকগঞ্জ: পানি ও সংস্কৃতি
মানিকগঞ্জ থেকে হাফিজ শিশির ::
পানি। শুধু জীবন নয়, সৃষ্টির আদি থেকেই পানির সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে সভ্যতার বিকাশ আর সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ইতিহাস। পুরাণে মানব সৃষ্টির নিয়ামক হিসেবে যে পাঁচটি উপাদানের কথা বলা হয়েছে- আগুন, পানি, মাটি, বাতাস, আলো; তার অন্যতম এই পানি। পানি ব্যতিত জীবন তো বটেই, সভ্যতার বিকাশ ও সাংস্কৃতিক পরিচয় অনুসন্ধান অসম্ভব।
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই কৃষিকে ঘিরেই বিকাশ ঘটেছে সভ্যতার। আর পানি ব্যতিত কৃষিকাজের কথা চিন্তাও করা সম্ভব না। তাই পৃথিবীর ইতিহাসের সকল পর্যায়ে সকল সভ্যতার প্রাণভোমরা ছিলো জলাঞ্চল। যেহেতু সভ্যতার বিকাশ-বিজ্ঞান, দর্শন এবং সাংস্কৃতির বিকাশের সামষ্টিক ফল, তাই পানির সাথে সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের উৎসমূল বাঁধা পড়ে আছে।
আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতির একটি বড় অংশ দখল করে আছে পানি। দেবতা বিসর্জন থেকে শুরু করে চাষাবাদ আর এই চাষাবাদকে ঘিরে ধুয়াগান, ধানকাটার গান, নবান্ন উৎসব কিংবা আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে -থেকে- ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী, আমার সোনার ধানে গিয়েছে ভরি পর্যন্ত সর্বত্রই নদী, পানি আর এর সহচর্যে বাঙালির মানস বিকাশের চিত্রই প্রকাশিত হয়েছে। একারণেই বাঙালির পরিচয় দিতে বলা হয় গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ এর কথা। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নিদর্শন বড়ুচন্ডিদাশ এর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এ তাই অনিবার্যভাবে বারবার এসেছে যমুনা নদীর কথা আর যমুনাখন্ড, কালীয়দমনখন্ড, নৌকাখন্ড এর কাহিনী তো আবর্তিত-ই হয়েছে নদীকে কেন্দ্র করে। গুপ্ত বংশের শাসনামলে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টীয় ৫ম শতকে মানিকগঞ্জের ভূভাগ গঠিত হয়েছিলো। একসময় এই ভূখন্ড অসংখ্য ছোটবড় নদ-নদী দ্বারা বিভক্ত ছিলো। ধারণা করা হয় এইসব নদ-নদীর তীর ঘেসেই খ্রিষ্টীয় তের শতকের মাঝামাঝি জনবসতি গড়ে ওঠে। অসংখ্য সুফি-সাধক-দার্শনিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের চারণভুমি মানিকগঞ্জে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে শক্তিশালী সাংস্কৃতিক বলয়।
বাঙালি সাংস্কৃতিক চেতনার অন্যতম নিদর্শন ভাটিয়লি গান তার সুর খুঁজে পেয়েছে পানির চলন থেকেই। ভাটি অঞ্চলের মাঝি নৌকার বৈঠা বাইতে বাইতে আপন মনে যে গান গেয়ে ওঠে, তাই ভাটিয়ালী গান। পানির প্রবাহে মাঝির নৌকা দুলেদুলে চলে। দোল লাগে মাঝির কন্ঠেও। দুলে ওঠে গানের সুরও। তাই ভাটিয়ালী গানের সুরে বয়ে চলে জলের প্রবাহ-শান্ত, ধীর অলঙ্কার। বাঙালি সাংস্কৃতিক পরিচয়ের আর এক প্রকাশ নৌকাবাইচ শুরু হয় মোঘল পৃষ্ঠপোষকতায়। আর এই নৌকাবাইচকে ঘিরেই সৃষ্টি হয়েছে সারি গানের ধারা। একজন গায়েন গলা ছেড়ে গান ধরেন আর তাঁর গানের তালে বৈঠা চালান একদল মাঝি। টানটান উত্তেজনা। কে জেতে কে হারে। আল্লাহ, রাসুল, ভগবান সবাই স্থান করে নেন এই গানে।
নদী তীরবর্তী জেলে সম্প্রদায়ের মনসা পূঁজার প্রচলন আদিকাল থেকেই। বর্ষাকালে যখন বাড়ির উঠান পর্যন্ত পানি থৈ থৈ- সাপের উপদ্রব বাড়ে, তখন তা থেকে নিস্কৃতি পেতে সনাতন-মুসলিম উভয় সম্প্রদায় এই পূজা অর্চণা করে থাকে। চাঁদ সওদাগরের সাত সন্তান হারানো এবং সতী পুত্রবধু বেহুলার দ্বারা সকল সন্তানকে পুনরায় যমলোক থেকে ফিরিয়ে আনার কাহিনী ধর্মীয় কৃত্য হিসেবে হাস্তর, পালা, কিচ্ছা-কথন, পুথি প্রভৃতি রীতিতে উপস্থাপিত হয় এই পূজা উপলক্ষে।
বর্ষাকালে যদি বৃষ্টি নামতে দেরি হয় তবে বাঙালি গেয়ে ওঠে বৃষ্টি নামানোর গান, কোথাও কোথাও এর আবশ্যক অনুষঙ্গ হিসেবে যুক্ত হয় ব্যাঙের বিয়ে। তখন এর নাম বদলে হয় ব্যাঙ বিয়ের গান। ব্যাঙ যুক্ত হবার কারণ, ব্যাঙ ডাকলেই বৃষ্টি নামবে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা বৃষ্টি নামানোর গান গাইতে গাইতে বিভিন্ন বাড়িতে বাড়িতে যায় এবং চাল-ডাল সংগ্রহ করে। তারপর সংগৃহীত এই চাল-ডাল মিলিয়ে খিচুরি রেঁধে কোন বাড়ির আঙ্গিনায় কলার পাতায় শিরনি বিতরণ করা হয়। গ্রামের সকল মানুষ অংশগ্রহণ করে এই শিরনিতে।
এক সময় বাঙালি সমাজে সমস্ত বিয়ের অনুষ্ঠান হত বর্ষাকালে। বরযাত্রী যেতেন নৌকায়, কনেকে নিয়ে ফিরতেন নৌকায়। পানিপথ ছাড়া বিয়েতে যাবার কথা কেউ চিন্তাই করতেন না। সময় পাল্টেছে, পাল্টেছে মানুষের জীবনযাত্রা, পাল্টাছে সংস্কৃতি। মুক্তবাজার অর্থনীতি, বৈশ্বিক সংস্কৃতি (আকাশ সংস্কৃতি) যার প্রভাবই বলা হোক না কেন, সেটা কেবল একটা নিয়ামক মাত্র। আমাদের দেশের নৌকাবাইচ হারিয়ে যাচ্ছে, অথচ আমরা কেবল টিভিতে বসে সেই প্রতিযোগিতাই দেখছি। সুতরাং মূল সমস্যাটা অন্যখানে। লালনের ভাষায়, চাতক বাঁচে কেমনে, মেঘের বরিষন বিনে ?
মানিকগঞ্জের কালিগঙ্গা, ধলেশ্বরী এবং ইছামতি নদী পলি পরে শুকিয়ে যাচ্ছে। দূর পাল্লার ইষ্টিমার চলাচল এবং বেশ কিছু ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল এই ধলেশ্বরী নদীকে কেন্দ্র করে। বর্তমানে কালীগঙ্গা নদীতে যতটুকু পানি আছে তাও বিষাক্ত ও দূষিত হয়ে পড়ছে বর্জ্য ফেলার কারণে। ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে এই নদীর পানি। মানিকগঞ্জের উপর দিয়ে বয়ে গেছে কাটখালী, গাজীখালী, নয়াকান্দির খালসহ আরও অসংখ্য খাল। কিন্তু মানিকগঞ্জের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া খালগুলোতে পূর্বের মতো আর প্রবাহ নেই। ভরাট করে খালের দুই ধারের অনেকেই অবৈধ স্থাপনা তৈরি, ময়লা ও বর্জ্য ফেলে খালের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধাগ্রস্ত করছে। এর ফলে খালের প্রস্থ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এই জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক বিল। বিলগুলোতে বর্ষা মৌসুম ছাড়া সারাবছর পানি থাকে না। প্রকৃতির তৈরি নিলুয়া বিল অবহেলা আর সভ্যতার অত্যাচারে ধ্বংস হতে বসেছে। কালিগঙ্গা নদীর পূর্ব পাশের কুল ঘেষে এক সময়ের বিখ্যাত গজারিয়া বিল এখন গজারিয়া চক নামেই বেশি পরিচিত ।
কোন জাতিকে ধ্বংস করার প্রধান লক্ষ্যস্থল হল তার সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা। নদীমাত্রিক আমাদের এই দেশের সংস্কৃতিক পরিমন্ডল তৈরিই হয়েছে পানিকে ঘিরে। বিভিন্নভাবেই আমরা প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছি আমাদের এই পানির উৎসগুলো। ফলে পানির অভাবে এই উৎসবগুলো আর হয়ে উঠছে না। হারিয়ে যাচ্ছে, এমনকি আমাদের স্মৃতির পাতা থেকেও।